রাজনীতি

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তে পাল্টাপাল্টি অবস্থান

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে গত কয়েকদিন ধরে। পাটকল বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন মন্ত্রীসহ সরকারের লোকজন। আর দেশের বাম সংগঠনগুলোর নেতারা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পাটকল বন্ধ না করার পক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরছেন। মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে বাম নেতারা বিবৃতি, মানববন্ধন, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন।

Advertisement

সরকারের শরিক দল দেশের ওয়ার্কার্স পাটি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নেতারা পাটকল বন্ধের বিরোধিতা করছেন এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন তারা। সবমিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের বিপক্ষে ফুঁসে উঠছে বামদলগুলো।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন পাটকলগুলো বন্ধের পরিকল্পনা করে সরকার। সেক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে পুনরায় চালু করা হবে পাটকলগুলো। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা থেকে মুক্ত হতে এ পরিকল্পনা করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহু বছর ধরেই দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর লোকসানে চলছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছিল সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে। বর্তমানে ২৫টি পাটকলে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক রয়েছেন, যাদের বেতন-ভাতা নিয়মিতভাবেই বকেয়া হয়ে পড়ে। পাওনা আদায়ের জন্য এ শ্রমিকদের প্রায়ই আন্দোলনে নামতে হয়। আবার বিগত বছরগুলোয় যারা অবসরে গিয়েছেন, তাদেরও অবসরসুবিধা বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা পাওনা আছে। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব পাটকলের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

Advertisement

তবে সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে বাম দলগুলো। নেতারা বলছেন, পাটকল বন্ধ করে বা পিপিপি ভিত্তিতে পুনরায় চালু করে এর সমাধান পাওয়া যাবে না। তারা পাটকল পরিচালনা কেন্দ্র বিজেএমসির মাথাভারী প্রশাসন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ছাঁটাই, পাটক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করার কথা বলছেন।

বাম নেতারা বলছেন, সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, ভুলনীতি এবং মাথাভারী ও অদক্ষ প্রশাসন লোকসানের জন্য দায়ী, শ্রমিকরা নয়। কারণ মৌসুমে জুলাই-আগস্ট মাসে পাটের দাম যখন ১০০০-১২০০ টাকা থাকে তখন পাট না কিনে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যখন পাটের দাম ২০০০-২২০০ টাকা হয় তখন পাট কেনা হয় এবং চাহিদার চেয়ে কম পাট ক্রয় করা হয়। বিদেশে বাজার খোঁজা, পণ্যের বহুমুখীকরণ এসবই মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসিসহ প্রশাসনের কাজ। ফলে লোকসানের দায় কোনোভাবেই শ্রমিকরা নেবে না।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী রোববার (২৮ জুন) বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কার্যক্রম পর্যালোচনা বিষয়ে ব্রিফিংয়ে বলেন, ‌বিজেএমসির ক্রমবর্ধমান লোকসানের কারণে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায় অবসায়নের মাধ্যমে মিলগুলোকে বর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযাযী আধুনিকায়ন করা হবে। মন্ত্রী জানান, ২০১৪ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের (৮৯৫৪ জন) প্রাপ্য সকল বকেয়া, বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকদের (২৪৮৮৬ জন) প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ জমা), গ্র্যাচুইটি এবং সেই সঙ্গে গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ ২৭% হারে অবসায়ন সুবিধা একসঙ্গে শতভাগ পরিশোধ করা হবে। এজন্য সরকারি বাজেট থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হবে।

মন্ত্রী আরও বলেন, অবসায়নের পর মিলগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে পিপিপি বা যৌথ উদ্যোগ বা জিটুজি বা লিজ মডেলে পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হবে। নতুন মডেলে পুনচালুকৃত মিলে অবসায়নকৃত বর্তমান শ্রমিকেরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবেন। একই সঙ্গে এসব মিলে নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে।

Advertisement

পাটকল বন্ধ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, পাটকল বন্ধ করা বিএনপি-জামায়াত সরকারের গৃহীত নীতিমালারই অনুকরণ মাত্র। তিনি বলেন, পাটকল পরিচালনা কেন্দ্র বিজেএমসির মাথাভারী প্রশাসন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা যারা পাটক্রয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম করেছেন, যারা মৌসুমে পাট সরবরাহ করেননি, যারা উৎপাদিত পাটপণ্য বিপণনে কোনো ভূমিকা রাখেননি, যাদের কারণে ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্প লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পাটকল বন্ধ করে কথিত গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দ্বারা শ্রমিকদের বিদায় করা অমূলক।

মেনন বলেন, করোনার এই মহামারির সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ও শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করার ঘটনা ব্যক্তি মালিকানাখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করবে। একইভাবে তারা তিনগুণ শ্রমিক ছাঁটাই করবে। যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, গত ১১ বছরে পাটকলগুলোকে লাভজনকভাবে পরিচালনার বিষয়ে সরকার, বিজেএমসি, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দফায় দফায় আলোচনায় পাটক্রয়ে লোকসান-দুর্নীতি বন্ধে মৌসুমে যথাসময়ে কাঁচাপাট ক্রয় করা, কারখানা পরিচালনা ব্যয়ে দুর্নীতি বন্ধ, পণ্য মোড়কে ‘পাট ব্যবহার আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করা, পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করা, পাটের ব্যবহার বহুমুখীকরণসহ বাস্তবসম্মত বেশকিছু সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু সরকারের ভেতরের এক গোষ্ঠী সেই সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব বাস্তবায়ন না করে পাটকলগুলোকে অচল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়।

তিনি বলেন, পাটকলগুলোকে অচল রেখে অলাভজনক করে ফেলার দায়িত্ব শ্রমিকদের না। পাটক্রয়, কারখানা পরিচালনা করা, উৎপাদিত পণ্য বিপণনের কোনো ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পাটচাষ, পাটশিল্প এবং পাটজাত দ্রব্য ওৎপ্রোতভাবে যুক্ত। ৫০ লাখ পাট চাষি, পাট শ্রমিক, পাট ব্যবসায়ীসহ প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এ অবস্থায় পাটকল বন্ধ করার আজগুবি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে পাটকলের পুরনো যন্ত্রাংশ বাতিল করে উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক যন্ত্রাংশ সংযোজন করে পাটকলগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর ও চালু রাখা হোক।

জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহে পাটের জেনোম আবিষ্কার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন পাটের পুনর্জাগরণের কথা বলছেন, তখন পাটকল ও পাটশিল্প ধ্বংসের জন্য অন্তর্ঘাত চালানো হচ্ছে। তিনি পাটকল বন্ধ করার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা, পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন, পাটক্রয়ে দুর্নীতি বন্ধ, পণ্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ করা, পণ্যের মোড়কে ‘পাট ব্যবহার আইন, ২০১০’ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতাসহ অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির টাকা পরিশোধ করার দাবি জানান।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, করোনা সংক্রমণের এই দুর্যোগকালে এমনিতেই যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, বিদেশ থেকেও অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরছেন, সেই সংকটকালে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন কথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করার গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার ফলে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে প্রায় ৫৫-৬০ হাজার শ্রমিক কাজ হারাবেন। তাদের পরিবার এবং ৪০ লাখ পাটচাষি ও তাদের পরিবার, পাট ব্যবসায়ী মিলে মোট প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ চরম বিপাকে পড়বেন।

শাসকশ্রেণি মাথাব্যথ্যার জন্য মাথা কেটে ফেলার পদ্ধতি অনুসরণ করছে বলে মন্তব্য করেন বাম ঐক্য ফ্রন্টের সমন্বয়ক, গণমুক্তি ইউনিয়নের আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যখন বিশ্বব্যাপী পলিথিনের বিকল্প বিবেচনায় পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের কদর বাড়ছে, এই শিল্পের বাজার তৈরি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন সরকার পাট সেক্টরে বিদ্যমান সমস্যা দূর না করে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের ভ্রান্তনীতি ও অব্যবস্থাপনায় দেশের ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর আগে বিএনপি সরকারের সময় দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী বন্ধ করে দেয়া হয়।’

এ প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ বলেন, পাটকল শ্রমিকেরা ভুল বুঝছেন। সরকারি পাটকল কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সেগুলো পরিচালনার কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো কোনো দিক দিয়েই ঠিকমতো চলছে না। বেসরকারি পাটকলের চেয়ে খরচ তিনগুণ বেশি। ফলে সরকার টাকা দিলেও পাটকলগুলো চালানো সম্ভব না।

সরকারি পাটকল বন্ধ করা প্রসঙ্গে খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের সাবেক সিবিএ সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, শ্রমিকেরা কেউ চান না পাটকল স্থায়ীভাবে বন্ধ হোক। এজন্য তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কর্মসূচি থেকে আমরণ অনশনের ডাক আসতে পারে।

তিনি বলেন, লোকসানের কথা বলে সরকারি পাটকল বন্ধ করা হচ্ছে। তবে লোকসান হয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নীতি-নির্ধারণের কারণে। ভরা মৌসুমে পাট কেনা হলে ও উৎপাদিত পণ্য ঠিকমতো বিক্রির ব্যবস্থা করলে মিলগুলো লাভের মুখ দেখবে বলে দাবি করেন তিনি।

বিজেএমসির অধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও তিনটি ননজুট কারখানা। ঢাকা অঞ্চলে সাতটি, চট্টগ্রামে ১০টি ও খুলনা অঞ্চলে নয়টি পাটকল রয়েছে। পাটকলগুলোতে বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৪ হাজার ৮৫৫ জন। এছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। তবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় থাকবেন কেবল স্থায়ী শ্রমিকেরা। এছাড়া কর্মচারীদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।

এফএইচএস/এসআর/পিআর