বিশেষ প্রতিবেদন

ভারত-চীন উত্তেজনায় ‘ভারসাম্যমূলক’ অবস্থানের পরামর্শ

লাদাখের গালওয়ানে ভারত-চীনের মধ্যকার সংঘাতের পর সেখানকার পরিস্থিতি কিছুটা প্রশমিত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক সমীকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুই দেশেরই বন্ধু হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সেটা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে এশিয়ার এই দুই শক্তির যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান ভারসাম্যমূলক হওয়া-ই উচিত বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

Advertisement

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান জাগো নিউজকে বলেন, যদি কখনও দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়া উচিত ভারসাম্যমূলক। অর্থাৎ বাংলাদেশ কারও পক্ষ নেবে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ চীনে যেমন আছে, ভারতেও আছে। ফলে বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হবে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আলোচনার জন্য চীন ও ভারতকে এক টেবিলে বসানোর উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করেন ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, নব্বইয়ের শেষের দিকে ভারত ও পাকিস্তান যখন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবারও পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি এমন উদ্যোগ নিতে পারেন।

Advertisement

‘ভারত ও চীন যুদ্ধে নামলে বাংলাদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে’ উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, যুদ্ধ যদি হয় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষিণ এশিয়া ক্ষতিগস্ত হবে। আমাদের সাপ্লাই লাইন বন্ধ হবে। আমাদের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে।

তবে ড. তারেক মনে করেন, ভারত ও চীনের মধ্যে আদৌ যুদ্ধ হবে না। কারণ দুই দেশই জানে যে, এই যুদ্ধের ফলে যে ক্ষতি হবে তা তারা সামাল দিতে পারবে না। চীন ও ভারতের মধ্যেও বিরাট বাণিজ্য আছে। এই বাণিজ্য বন্ধ হোক, তা দুই দেশেরই কেউই চাইবে না।

তার মতে, ‘যুদ্ধ না হলেও এখন দুদশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। আর তা পরোক্ষভাবে উসকে দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি মূলত চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছে।’

ড. তারেক বলেন, ‘স্নায়ুচাপ…। ভারত নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে চোখ চীনের সাথে দ্বন্দ্বের দিকে নিতে চাইছে। ইতোমধ্যে এ লক্ষ্যে মোদি সফল বলা যায়। কারণ তিনি করোনা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের অর্থনীতির খুব খারাপ অবস্থা। এটা একটা স্নায়ুবিক যুদ্ধ।’

Advertisement

একই ধরনের মত দেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ভারত-চীনের মধ্যে যুদ্ধ হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই কোনো পক্ষ নেয়া যাবে না। তিনি বলেন, আমরা চাইব যুদ্ধ না হোক। আর হলেও আমাদের কোনো পক্ষ নেয়া চলবে না।

তার মতে, ‘প্রতিবেশী দেশে যুদ্ধ হলে আমরা অবশ্যই ভালো থাকব না। এই দেশ দুটোর সাথেই আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। ফলে যুদ্ধ হলে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশও।’

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ কোনোভাবেই যুদ্ধ সমর্থন করে না। তাছাড়া আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো- কারও সাথে বৈরিতা নয়। এ নীতিতেই চলছে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ভারত-চীন জটিল সম্পর্কের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপরও। আর যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে সুসম্পর্ক রাখা দুই দেশের মধ্যে থেকে কাউকে বাছাই করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে ঢাকার জন্য।

উল্লেখ্য, গত ১৫ জুন হিমালয় পর্বতের পশ্চিমাংশে প্রায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতার গালওয়ান উপত্যকায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় ভারত ও চীন। দুই পক্ষের সেনাদের সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা নিহত ও অন্তত ৭৬ জন আহত হয়। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস চীনের দিকেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করে। তবে তারা বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

দীর্ঘ আলোচনার পর দুই দেশই সীমান্ত থেকে সেনা সরানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুসারে, গত সোমবার দুই পক্ষের সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে এই সমঝোতা হয়।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, দুদেশের চলমান উত্তেজনা ঘিরে বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে মোদি সরকার

ভারত-চীন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জানান, ইউরোপে তাদের প্রধান ঘাঁটি জার্মানি থেকে সরিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হবে। বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না চীন। মার্কিন এই তৎপরতাকে অবাঞ্ছিত বলে সমালোচনা করেছে দেশটি।

এদিকে ভারতের সাথে চলমান উত্তেজনার মধ্যে চীন বাংলাদেশের অতিরিক্ত ৫১৬১টি পণ্যের শুল্ক মওকুফ করায় সমালোচনায় মুখর হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। এটা ঢাকা-কে পাশে পেতে চীনের নতুন প্রচেষ্টা বলে মনে করছে তারা। এ বিষয়ে তীর্যক মন্তব্যও করে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম।

তবে এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জাগো নিউজকে বলেন, চীন যে সুযোগ দিয়েছে তা দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফল। মনে রাখতে হবে, চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক বাণিজ্যিক। অন্যদিকে ভারতও আমাদের পরম বন্ধু।

জেপি/বিএ/এমএআর/এমএস