মতামত

ওয়েব সিরিজ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক!

বিতর্ক যেন থামছেই না বাংলাদেশের সবশেষ তিনটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে। অ্যাপস থেকে সিরিজগুলো সরানো হলেও নেটিজনরাতো বটেই সরকারি মহল থেকেও বিষয়টি নিয়ে বেশ আঁটঘাঁট বেঁধেই নামা হয়েছে। সবশেষ গেল ২৪ জুন গ্রামীণফোন ও রবি’র কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়।

Advertisement

তাদের কাছে পাঠানো পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘আপনার প্লাটফর্ম এবং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সম্প্রতি ওয়েব সিরিজের নামে সেন্সরবিহীন নগ্ন, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য, কাহিনী ও সংলাপ সম্বলিত ভিডিও কন্টেন্ট ওয়েবে আপলোড করে প্রচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে, বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে দেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে প্রচার করেছে এবং সমাজে এর ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের ভিডিও কন্টেন্ট আপনার প্লাটফর্ম এবং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ওয়েবে আপলোড এবং প্রচার করার জন্য আপনার প্রতিষ্ঠান সরকারের কোনো রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত কিনা এবং থাকলে তা কী- তা সরকারের জানা প্রয়োজন।‘

আমাদের দেশে ওয়েব সিরিজের ধারণাটি মূলত নতুন। ইংলিশ, স্প্যানিশ বা হিন্দি ওয়েব সিরিজের সঙ্গে আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে পরিচিত রয়েছি। এরপর পরিচয় হলো ওপার বাংলার ওয়েব সিরিজের সাথে। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের যাত্রা ২০১৭ সালে। ওই বছর ঈদুল ফিতরে টিভির পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রকাশ পায়। এর মধ্যে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে সাত পর্বের ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই’ ও ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’, ‘এল আমোর টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ‘টেস্টিং সল্ট’, বাংলা ঢোলের উদ্যোগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম বাংলাফ্লিক্সে প্রচার পায় বিশেষ নাটক ‘উপহার’।

বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা মূলত তখন। এরপর ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহায়ও প্রকাশ পায় একাধিক নাটক। এরপর নানা সময়ে ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে নানা ওয়েব সিরিজ প্রচার হতে থাকে। এগুলো নিয়ে নানা সময়ে সমালোচনা হলেও তা থেকে যেত একসময়। কিন্তু এবারের ঝড়টা যেন ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। গেল ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া তিনটি ওয়েব সিরিজ, শিহাব শাহীনের ‘অগাস্ট ১৪’, ওয়াহিদ তারেকের 'বুমেরাং’ ও সুমন আনোয়ারের ‘সদরঘাটের টাইগার’ নিয়ে বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। এর একটি কারণ অবশ্য এই ওয়েব সিরিজগুলো তাদের নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। একশ্রেণির দুস্কৃতিকারী সেগুলো ইউটিউবের মতো প্লাটফর্মে ছড়িয়ে দেয় এবং সেখান থেকে খণ্ডিত ক্লিপ আকারে নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

Advertisement

যেহেতু বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সংবাদমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে নেতিবাচক সংবাদই বেশি প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওয়েব সিরিজের যেই ধারণা তাতে এ ধরনের ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল না। ওয়েব সিরিজ ধারণাটি কী? ওটিটি বা ওভার দ্য টপ হলো প্লাটফর্মটির নাম যেভাবে ওয়েব সিরিজগুলো দেখা যায়। ইন্টারনেট-ভিত্তিক প্লাটফর্ম যেখানে কাউকে প্লাটফর্মটি ডাউনলোড করতে হয়। এরপর নির্ধারিত ফি দিয়ে গ্রাহক হতে হবে। তারপর সেখানে থাকা অসংখ্য কনটেন্টের ভেতর থেকে যে কেউ বেছে নিয়ে পছন্দনীয় কনটেন্ট দেখতে পারেন। অর্থাৎ এটি টেলিভিশনের মতো সেট ওপেন করে রিমোট ঘুরালেই কোনো চ্যানেলে আসবে না। আবার ইউটিউবের মতো ফ্রি জায়গাও নয় যে কনটেন্টগুলো মন চাইলেই দেখে ফেললাম।

কিন্তু আমাদের যেহেতু চোর্যবৃত্তির মন, তাই যা হওয়ার তাই হলো। গেল গেল বলে রব উঠল। সেই রব ছড়িয়ে পড়ল ফেসবুকের পণ্ডিত সমাজের মাঝে এবং সেখানেও যথারীতি দুই ভাগে বিভক্ত। নাটকের শিল্পী, কলাকুশলীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিবৃতি দিলেন। একদল বললেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা অহরহ বিদেশি ওয়েব সিরিজে যৌনদৃশ্য থেকে শুরু করে নানা ভায়োলেন্স দেখছি। এখন এই সময়ে এসে যদি আমরা গোঁড়ামিতে আটকে থাকি তাহলে দেশের এই প্লাটফর্ম এগুবে কীভাবে।

দেশের ১১৮ জন সুপরিচিত নির্মাতা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের দেশে ওয়েব প্লাটফর্মে পথচলাটা যেহেতু খুব নতুন সেখানে প্রথমেই কোনো বিচ্যুতি বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা হবার কারণে যদি শুরুতেই এর চলার পথটা থমকে যায়, অথবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয় বা বৈচিত্র্যময় কন্টেন্ট নির্মাণের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তা বাংলাদেশের বিনোদন শিল্পের জন্য একটি বিরাট অন্তরায় হিসেবে দেখা দেবে।’

অপেক্ষাকৃত প্রবীণ শিল্পীরা বলছেন, এখন ওয়েব সিরিজে যা দেখানো হচ্ছে দেশ এটা দেখার জন্য প্রস্তুত না। শ্লীলতা বা অশ্লীলতাই একটা আপত্তির জায়গা। দুর্নীতি বা এ ধরনের অনাচার নিয়ে কিন্তু এসব সিরিজ হয় না, হয় সেক্স আর ভায়োলেন্স নিয়ে। কথা উঠেছে গল্পের প্রয়োজনে যৌনদৃশ্য নাকি যৌনদৃশ্যের প্রয়োজনে গল্প এসব নিয়েও।

Advertisement

প্রকৃতপক্ষে এখানে আমাদের মননগত একটা পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আমরা বাইরের জগৎ থেকে সবকিছু নিলেও নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আদ্যিকালের কুপমণ্ডুকতা ধরে রাখার পক্ষে। আমরা দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছি আবার ভ্রম বা সত্যের ভেদাভেদ করতে ভুলে যাচ্ছি। এ প্রসঙ্গে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেয়া আগস্ট ১৪ ওয়েব সিরিজের নির্মাতা শিহাব শাহীনের একটি বক্তব্য বেশ মনে ধরেছে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কারিনার ক্লিভেজ মুগ্ধ হয়ে দেখি আর মম’কে দেখি গালি দেই।’

উল্লেখ্য অভিনেত্রী মম শিহাব শাহীনের স্ত্রী। আসলেই তাই, আমাদের দেশে নতুন কিছুকে সহজে গ্রহণ করার প্রবণতা এখনও সে অর্থে তৈরি হয়নি বরং সেটিকে কীভাবে চাপিয়ে রাখা যাবে তার জন্য অসংখ্য পথ তৈরি হয়েছে। সে কারণে সৃজনশীল বিভিন্ন সেক্টরে কেউ নতুন কিছু করারও সাহস হারিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে। অবশ্য এটি নতুন নয়। নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে যখন সবাক চলচ্চিত্রের যুগ শুরু হচ্ছিল তখনও নাকি চার্লি চ্যাপলিন বিরোধিতা করেছিলেন। আবার আমাদের দেশে হুমায়ূন আহমেদ যখন খ্যাতির চূড়ান্তে তাঁর সাহিত্য নিয়ে যেমন সমালোচনার অন্ত ছিল না তেমনি তার বানানো চলচিত্রগুলো আদৌ সিনেমা হয়ে উঠেছে কি না তার বিশ্লেষণের শেষ ছিল না।

তেমন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর নাটকের ভাষা নিয়েও একসময় হৈ চৈ হয়েছে অনেক। পরে এখন সেটি যেন নাটকের নতুন আর আবশ্যকীয় ভাষা হয়ে উঠেছে! এটিই হচ্ছে মূলত নতুনকে গ্রহণ করতে না পারার হীনমন্যতা। হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন সিরিজে যে যৌনদৃশ্য রয়েছে তা আপনি দেখতে চান না, যে অশ্লীল সংলাপ আছে তা আপনি চান না। তাহলে আপনি সেটা না দেখলেই হলো, কারণ একথাতো ঠিক যে, সদরঘাটের কুলি যে ভাষায় কথা বলবে সংলাপ রচিয়তাতো সে ভাষাই ব্যবহার করবে। আবার মাদকাসক্ত এক কিশোরী বা তার বন্ধুরা যে ভাষায় কথা বলে, যে কাজ করে সেটিতো বাস্তবতার কারণেই ফুটিয়ে তুলতে হবে।

সবকিছুতে বাধা থাকলে একটি সমাজের সৃজনশীল অংশটি এগুতে পারে না। এখন যে প্লাটফর্ম থেকে ভিডিগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে তাতে কী দেখা বন্ধ হয়ে যাবে? তা কখনোই নয়। কারণ লাখ লাখ লোক সেগুলো ডাউনলোড করে রেখেছে এবং তা বিকল্প উপায়ে দেখছে। সবচেয়ে বড় কথা ওয়েব সিরিজে কোনো আপত্তি থাকলে সেটিকে সংশোধন করা যেত, কিন্তু সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার মতো পরিস্থিতিতো কাম্য নয়। একইসঙ্গে এটি যেহেতু উন্মুক্ত প্লাটফর্ম নয়, সে কারণে এর শতভাগ দায় কিন্তু ওই নির্মাতা বা প্রতিষ্ঠান নিতে পারে না।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

এইচআর/বিএ/পিআর