সারা বিশ্বের মানুষ এখন করোনাভাইরাস আতঙ্কে। এই ভাইরাস একেক জনের দেহে এত বিচিত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ সৃষ্টি করে, যা বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করছে। করোনা আক্রান্ত অনেকে অত্যন্ত দ্রুত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, আবারও কারো শরীরে দেখা যাচ্ছে খুবই মৃদু উপসর্গ। আবার অনেকের করোনা পজিটিভ নিশ্চিত হওয়ার পরও কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না।
Advertisement
এ পরিস্থিতিতে একটা প্রশ্ন বারবারই ঘুরে ফিরে আসছে যে, করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কার ক্ষেত্রে কতটা? এটা কি আগে থেকে অনুমান করা এবং সে অনুযায়ী সতর্ক হওয়া সম্ভব?
বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি কয়েকটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের রক্তের গ্রুপের সাথে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সম্পর্ক আছে।
বিজ্ঞানীরা প্রথম দিকে রক্তের গ্রুপের সাথে করোনা সংক্রমণের সম্পর্ক আছে বলে মনে করতেন না। তবে এখন গবেষকরা দেখছেন, এ দুটির মধ্যে সম্পর্ক আছে এবং এ, বি বা এবি গ্রুপের রক্তবিশিষ্ট মানুষের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত বা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি করোনা কার মৃত্যুর ঝুঁকি কতটা তার আভাস পেতেও সহায়ক হতে পারে রক্তের গ্রুপ।
Advertisement
বিবিসির বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদদাতা হেলেন ব্রিগস লিখছেন, টুয়েন্টিথ্রিঅ্যান্ডমি নামে একটি জেনেটিক টেস্টিং কোম্পানির চালানো একটি গবেষণাতেও বলা হচ্ছে, যাদের রক্তের গ্রুপ ‘ও’, তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা এ, বি বা এবি গ্রুপের রক্তের লোকদের চেয়ে ৯ থেকে ১৮ শতাংশ কম।
৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ ফল পাওয়া গেছে এমন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রক্তের টাইপ ‘ও’ এমন লোকের সংখ্যা সবচেয়ে কম। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে ‘এবি’ গ্রুপের রক্তের অধিকারীরা।
গবেষকরা দেখেছেন. করোনাভাইরাসে আক্রান্তের বয়স, লিঙ্গ, ওজন, জাতিগত বা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং আগে থেকে থাকা স্বাস্থ্য সমস্যা বিবেচনায় নেয়ার পরও, করোনা সংক্রমণে ঝুঁকির ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপের ভূমিকা একই থাকছে।
তবে একাধিক জরিপে রক্তের টাইপের সাথে করোনার সংক্রমণ কত মারাত্মক হবে তার একটা সম্পর্ক দেখা গেছে। গেল সপ্তাহেই ইতালি ও স্পেনে চালানো জেনোমওয়াইড অ্যাসোসিয়েশনের চালানো এক জরিপে বলা হয়, করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের রক্তের টাইপ 'এ' তাদের অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
Advertisement
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, মানুষের জিন, রক্তের গ্রুপ ও কোভিড-১৯– এগুলোর মধ্যে পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক প্রথম চিহ্নিত করে ইউরোপের একটি জরিপ। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, ইতালি ও স্পেনের ৭টি হাসপাতালের ১ হাজার ৯৮০ জন রোগীর ওপর এ জরিপ চালানো হয়। এতে বলা হয়, রক্তের 'এ' গ্রুপধারীদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি এবং ও গ্রুপধারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। যাদের রক্তের টাইপ এ পজিটিভ তাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটর দরকার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বেশি।
এর আগে চীনে চালানো একটি জরিপেও এমন তথ্য উঠে আসে। মেডআরকাইভ অনলাইন জার্নালে প্রকাশিত ওই জরিপে বলা হয়, উহান ও শেনঝেনের তিনটি হাসপাতালের ২ হাজার ১৭৩ জন করোনাভাইরাস রোগী এবং আক্রান্ত হয়নি এমন লোকদের উপাত্ত তুলনা করে দেখা গেছে, রক্তের এ গ্রুপধারীদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি। সেখানেও দেখা যায় ‘ও’ টাইপ রক্তের মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যেসব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়– তা পালন না করার জন্য এসব জরিপকে ব্যবহার করা ঠিক হবে না।
ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেরি কুশম্যান বলেন, সামাজিক মাধ্যমে এমন কথা দেখা গেছে যে একটি পরিবারের যে সদস্যের রক্তের টাইপ ও, তাকে কেনাকাটা করার জন্য দোকানে পাঠানো উচিত কিনা। কিন্তু কারো রক্তের টাইপ ও বলে তাকে কম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে– এমন চিন্তা করা ঠিক না।
এই গবেষণাগুলোর সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বলেছেন, রক্তের গ্রুপই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির পেছনে প্রধান কারণ কিনা, বা এর পেছনে অন্য কোনো জেনেটিক উপাদান কাজ করছে কি-না তা এখনও স্পষ্ট নয়।
মানুষের রক্তের টাইপ প্রধানত চারটি– এ, বি, এবি এবং ও। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জিনের মাধ্যমে প্রত্যেকের রক্তের টাইপ নির্ধারিত হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমিত কিছু লোকের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া এবং অন্য কিছু লোকের ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গ হওয়া– এর পেছনে কোনো জেনেটিক কারণ কাজ করছে কি-না তা নিয়ে সম্প্রতি অনেকগুলো গবেষণা চালানো হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানব জেনোমের দুটি বিন্দুতে যে পার্থক্য দেখা যায়। তার সাথে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ার বর্ধিত ঝুঁকির সম্পর্ক আছে। এই দুটি বিন্দুর একটি এমন কিছু জিন আছে যা মানুষের রক্তের টাইপ নির্ধারণ করে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই জরিপটি অন্য কিছু দিক থেকেও ছিল বিস্ময়কর। মানুষের দেহ কোষের বাইরের দিকে থাকা এ সি ই টু নামে একটি প্রোটিনের সাথে নিজেকে আটকে দিয়ে করোনাভাইরাস কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু যারা করোনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাদের ক্ষেত্রে এ সি ই টুর জেনেটিক পার্থক্য কোনো ভূমিকা রাখেনি।
এই জরিপের অন্যতম প্রণেতা জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক বিশেষজ্ঞ আন্দ্রে ফ্রাংক বলেন, যেসব দিকগুলোর দিকে আমরা অপেক্ষাকৃত কম নজর দিয়েছি হয়তো সেগুলোই করোনাকে জীবনাশঙ্কা তৈরির মতো পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়র পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, করোনা আক্রান্তদের বয় এবং আগে থেকেই হাঁপানি, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসের মত স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল এমন লোকদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। করোনাভাইরাসে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি মারা গেছেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যু ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি। সম্প্রতি ব্রিটেনে কিছু গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এমএসএইচ