দেশজুড়ে

যে গ্রন্থাগারের অস্তিত্বই নেই সেখানে এলো সরকারি অনুদান

নামে থাকলেও কোনো কার্যক্রমে নেই শেরপুরের বেশিরভাগ বেসরকারি গ্রন্থাগার। এলাকার সাধারণ জনগণ জানেনই না এসব গ্রন্থগারের কথা। তবুও চলতি বছরে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে ২০টি বেসরকারি গ্রন্থাগারের নামে। এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন স্থানীয় পাঠক ও লেখকরা। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস জেলা প্রশাসনের।

Advertisement

বই পড়া কার্যক্রমকে বেগবান করতে অনুদানের জন্য গেল বছরের নভেম্বরে বেসরকারি গ্রন্থাগারের আবেদন আহ্বান করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নির্দিষ্ট ফরমে অনুদানের জন্য আবেদন করে শেরপুরের ২২ বেসরকারি গ্রন্থাগার। গত ২২জুন ‘অন্যান্য অনুদান’ খাত থেকে তিনটি শ্রেণিতে শেরপুরের ২০টি গ্রন্থাগারের জন্য ৯ লাখ ১৯ হাজার টাকা মঞ্জুরির স্মারক প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। ২৫ জুন (বৃহস্পতিবার) রাতে জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের ফেসবুক পেজে তালিকা প্রকাশের পর নিন্দার ঝড় ওঠে।

অনুসন্ধানে বরাদ্দ পাওয়া ২০টি গ্রন্থাগারের মধ্যে ১০টির দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। বাকি ১০টির কয়েকটি পুরোনো সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ। বেশিরভাগ গ্রন্থাগার করা হয়েছে বাড়ির বারান্দায়, যেখানে শুকাতে দেয়া হয়েছে কাপড়। বইয়ের তাক বা আলমারি থাকলেও কয়েক স্তরের ময়লা ও মাকড়সার জাল জমা পড়েছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে আলমারিতে পুরোনো পত্রিকা সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন দায়িত্বরত একজন।

আরেক গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায় সংবাদিক আসার খবর পেয়ে জাতির পিতা ও সরকার প্রধানের ঝুলানো ছবি পরিষ্কার করার চিত্র। চা স্টলের আলমারিতে পাঠ্যবই রেখে বানানো হয়েছে গ্রন্থাগার। একই পরিবারে বাবা ও মেয়ের নামে আলাদা দুটি গ্রন্থাগারের তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে।

Advertisement

নিজ এলাকায় এসব নাম সর্বস্ব গ্রন্থাগারের কথা জানে না কেউই। অনুদানের টাকা লুটপাটের আশংকা স্থানীয়দের। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এসব ব্যাপারে কিছুই জানেন না।

শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামে কোনো পাঠাগারের কথা আমরা শুনিনি। কেউ যদি পাঠাগারের নামে টাকা নেয়ার চেষ্টা করে তাহলে এটা অপরাধ। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।

একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হায়দার আলী বলেন, এসব পাঠাগারের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। তবুও সরকার যদি কোনো বরাদ্দ দেয় তাহলে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরেজমিনে তদন্ত করে দেয়া উচিৎ। তাহলে সবাই এর সুফল পাবে।

কার্যক্রম ছাড়া অর্থ বরাদ্দ নেয়া দুর্নীতির সামিল বলে মনে করছেন স্থানীয় পাঠক ও লেখকরা। তরুণ লেখক হুইসেল হোসেন বলেন, যারা এই পাঠাগার করেছেন কেউই স্থানীয় বাজার থেকে কখনোই বই কেনেননি। এমনকি কখনো কোনো বইমেলাতে তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। এই অর্থ তারা লোপাট করার চেষ্টা করছেন।

Advertisement

এদিকে স্থবির কার্যক্রমের কথা স্বীকার করে অনুদান পেয়ে পুরোদমে চালুর কথা জানিয়েছেন গ্রন্থাগার সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানের কথা শুনে চটে গিয়ে আনিসুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক আনিসুর রহমান বলেন, ‘এই কয়টা টাকা তো সরকারের ভিক্ষা। নিবন্ধন করতে অফিসে অফিসে ঘুরেই তো এই টাকা খরচ হয়ে যায়। এইটা নিয়ে আপনাদের এত আগ্রহের মানে বুঝলাম না।’

নূর মোহাম্মদ স্মৃতি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক নূরনবী হোসেন বলেন, করোনার কারণে কার্যক্রম বন্ধ। কিছুদিনের মধ্যেই আবার চালু করা হবে।

যুব বিজ্ঞান ও মহিলা সংস্কৃতি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক আফসানা হোসেন মুক্তি বলেন, বেসরকারিভাবে চালানোর কারণে কার্যক্রম ছোট ছিল। এবার যেহেতু অনুদান পেয়েছি এখন থেকে বৃহৎ আকারে শুরু করা যাবে।

শেরপুর জেলা বেসরকারি গ্রন্থাগার সমিতির সভাপতি আফজল হোসাইন বলেন, বরাদ্দ না পাওয়ায় অনেকের কার্যক্রম বন্ধ ছিল, এখন সবাইকে ভালোভাবে কার্যক্রম চালাতে চিঠি দেয়া হবে।

অপরদিকে নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের ফেসবুক পেজ থেকে অনুদান পাওয়া গ্রন্থাগারের তালিকা সরিয়ে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক সাজ্জাদুল করিম বলেন, এই অনুদান দেয় জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র। কোন বিষয়ে এই অনুদান দেয়, এটা আমরা জানি না। আবেদনের প্রেক্ষিতে এই অনুদান প্রদান করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরসঙ্গে গণগ্রন্থাগারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তাই পোস্ট সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব বলেন, কার্যক্রম ছাড়া অনুদান গ্রহণের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শেরপুর জেলা বেসরকারি গ্রন্থাগার সমিতির তথ্যমতে জেলায় ২৮টি গ্রন্থাগার থাকলেও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সরকারি ওয়েবসাইটে রয়েছে মাত্র ১৭টির তথ্য, কিন্তু অনুদান দেয়া হয়েছে ২০টিকে। অনুদান দেয়ার আগে সরেজমিনে পরিদর্শনের আহ্বান স্থানীয়দের।

এফএ/এমএস