কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবিলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (বিডিডিএফ)। বৃহস্পতিবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপি ১২ দফা দাবিসহ এ সুপারিশ করেন।
Advertisement
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. কে বি এম সাইফুল ইসলাম। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২.০-২.৫ কোটি লিটার তরল দুধ উৎপাদন হয় যার বাজার মূল্য প্রায় ১০০-১২০ কোটি টাকা। কোভিড-১৯ এর ফলে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাত।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে’র প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র দেড় মাসে কৃষকের লোকসান হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকারও বেশি। কারণ, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদিত পণ্যসমূহ উচ্চপচনশীল এবং তা স্বল্প সময়ের মধ্যে বাজারজাত করতে হয়। কোভিড-১৯ এর ফলে খামারিরা তাদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে না পারায় তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এছাড়া খামারিরা গাভীগুলোকেও পর্যাপ্ত গো-খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না, ফলে দেখা দিচ্ছে গবাদিপ্রাণির নানাবিধ অসুখ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। এছাড়া বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোও সক্ষমতা অনুযায়ী দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়া ও বিক্রয় করতে পারছে না।
দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোর ভাষ্য মতে, তাদের বিক্রি প্রায় ৪০-৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় খামারিসহ সেক্টরসংশ্লিষ্ট সকলের ক্ষতি বিবেচনা বিগত তিন মাসে (মার্চ থেকে মে) এ খাতে লোকসান হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
Advertisement
কোনো খামারের গো-খাদ্য বাবদ ৫০ শতাংশের বেশি খরচ হলে ওই খামার বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে ডেইরি খামারের উৎপাদন খরচের শতকরা ৭০-৭৫ শতাংশ ব্যয় হয় গো-খাদ্য ক্রয়ে। এজন্য খামারের অব্যবস্থাপনা, উন্নত জাতের গাভীর অভাব দায়ী থাকলেও মূল সমস্যা হলো গো-খাদ্যের উচ্চ মূল্য। বাংলাদেশে গো-খাদ্য মূলত আমদানি নির্ভর। গো-খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বর্তমান প্রস্তাবিত বাজেটে কতিপয় খাদ্য উপাদান যেমন- সয়াবিন অয়েল কেক (আরডি ৫%) এবং সয়াবিন প্রোটিন কনসেনট্রেটের (সিডি ১০%) আমদানিশুল্ক কমানোর হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে খামারের উৎপাদন অব্যহত রাখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গো-খাদ্যের ওপর ভর্তুকি দেয়ার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি খাতেও বর্তমান বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডেইরি খাতে অদ্যাবধি এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র খামারিদের সুরক্ষায় গো-খাদ্যের ওপর ভর্তুকি দেয়া আবশ্যক।
বাংলাদেশের ডেইরি শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- আমদানিকৃত গুঁড়া দুধের সাথে অসম প্রতিযোগিতা। এসব গুঁড়া দুধ ভর্তুকিপ্রাপ্ত হওয়ায় এর দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম যার সাথে বাংলাদেশের স্থানীয় উৎপাদন প্রতিযোগিতা করতে পারে না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ গুঁড়া দুধের আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে। বাংলাদেশে গুঁড়া দুধের আমদানিশুল্ক মাত্র ১০%। কিন্তু এশিয়ার অন্যান্য দেশে এর হার ৫০ শতাংশের উপরে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ২.৫ কেজি প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্ত এই আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে দেশের ডেইরির উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখবে না। এক্ষেত্রে বাল্ক ফিল্ড মিল্কের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
দেশের ডেইরি সেক্টরের উন্নয়নের জন্য দেশীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে প্রতিযোগিতাপূর্ণ হতে হবে। এক্ষত্রে খামারের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ডেইরি পণ্যের উৎপাদন খরচও বেশি হয়। ফলে জাতীয় বাজারে ডেইরিপণ্য ভোক্তাবান্ধব না হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে তা প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারে না। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত সকল ডেইরিপণ্যের ওপর থেকে মূল্য সংয়োজন কর এবং শুল্ক প্রত্যাহার করা জরুরি। এছাড়া করোনার আঘাত থেকে মুক্ত করে ডেইরি সেক্টরকে টেকসই, মজবুত এবং এর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ১০ বছরের জন্য ‘ট্যাক্স হলি ডে’ ঘোষণা করা উচিত।
কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সুপারিশসমূহ-
Advertisement
১. ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা করা।
২. কোভিড-১৯ এর ক্ষতি মোকাবিলায় খামারিদের গো-খাদ্য ও খামারের উপকরণ ক্রয়ের জন্য ভর্তুকি প্রদান করা।
৩. সকল প্রকার দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ আমাদানি শুল্ক আরোপ করা। বিশেষ করে এইচএস কোড 0402.21.91 (Milk & cream in powd,gran or oth. solid form fat..exceed1.5% imp by VAT reg.Milk & pr) এবং এইচএস কোড 0402.21.99 (MILK AND CREAM IN POWDER, OF FAT >1.5% IMP.EXCL.VAT REG. MILK & MILK MFG.IND. এ যথাক্রমে ২৫% এবং ২০% CD ও SD আরোপ করা।
৪. দেশে উৎপাদিত সকল প্রকার ডেইরি পণ্যে শুল্ক ও করশূন্য হারে (০%) নির্ধারণ করা।
৫. স্থানীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারকে ডিজিটালাইজড ও প্রাতিষ্ঠানিক বাজারকে শক্তিশালীকরণের জন্য মধ্যম/দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় টাকার ‘গ্যারান্টি ফান্ড’ গঠন করা।
৬. সম্প্রসারণ সেবাকে ডিজিটালাইজড ও খামারিবান্ধব করা।
৭. গো-খাদ্যসহ সকল প্রকার ডেইরি উপকরণের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা।
৮. ডেইরি খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির সন্নিবেশ ঘটানোর জন্য মধ্যম/দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ‘গ্যারান্টি ফান্ড’ গঠন করা।
৯. ডেইরিতে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে গাভীবীমা চালু করা।
১০. প্রান্তিক কৃষক যাতে সহজেই পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত হয় সেজন্য লম্বা গ্রেস পিরিয়ডসহ জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদান।
১১. বিদেশ থেকে মাংস আমদানি বন্ধ করা।
১২. ডেইরি পলিসি অনুমোদনসহ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিডিডিএফ’র সহ-সভাপতি উজমা চৌধুরী, সহ-সভাপতি ড. কাজী ইমদাদুল হক, প্রচার সম্পাদক মো. মুতাসীম বিল্লাহসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ।
এমএআর/জেআইএম