বিনোদন

শুটিংয়ে যে ফিরব, আমার জীবনের দায় নেবে কে : চঞ্চল চৌধুরী

করোনা পরিস্থিতিতে নাটকের শুটিং বন্ধ ছিল মার্চ মাস থেকে। অনেক দিন শুটিং বন্ধ থাকায় এ শিল্পটির সাথে জড়িত বিভিন্ন শ্রেণির কলাকুশলীরা পড়েন চরম অর্থ সংকটে। বিশেষ করে যারা প্রতিটি নাটক থেকে স্বল্প আয় করেন তাদের পরিবার কষ্টে দিনযাপন করছে। এমন পরিস্থিতিতে নাটক সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো স্বাস্থবিধি মেনে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে।

Advertisement

কিন্তু যে হারে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, এই সময় কি শুটিং করা ঠিক হবে? দেখা যাচ্ছে অনুমতি মিললেও অধিকাংশ তারকা এ সময় শুটিংয়ে ফিরতে ইচ্ছুক নন, আবার কেউ কেউ অর্থ সংকট কাটাতে শুটিংয়ে ফিরছেন।

এর মধ্যে একটি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে তারকাদের শুটিংয়ে ফেরার আহ্বান জানিয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। চিঠিটি পেয়েছেন নন্দিত অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীও। করোনাকালে শুটিংয়ে ফেরা না ফেরা ও নানা প্রসঙ্গে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন ‘মনের মানুষ’, ‘আয়নাবাজি’, ‘মিসির আলি’ খ্যাত অভিনেতা। তুলে ধরা হলো সেই আলাপচারিতা।

জাগো নিউজ : অনেক দিন ধরেই ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছেন, এর মধ্যে শুটিং করার অনুমতিও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো, এই সময়ে কী শুটিংয়ে ফেরা সম্ভব?চঞ্চল চৌধুরী : এখন সব চেয়ে দুঃসময় চলছে। সংকটটাও অনেক বেশি। প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আমাদের আশপাশে আত্মীয়-পরিজন অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। শুটিংয়ে ফিরব কী করে!

Advertisement

যে কাজটি আমি দুই মাস আগে করলাম না, সেই কাজটি এমন পরিস্থিতিতে কেন করতে যাব! শুটিংয়ে যে ফিরব, আমার জীবনের দায় কে নেবে? অসুস্থ হলে তার দায় কে নেবে? এই সময় শুটিং করলে কেমন সচেতন হয়ে করতে হবে সেটাও বুঝতে পারছেন সবাই!

জাগো নিউজ : করোনার এই সময়ে সাস্থ্যবিধি মেনে কি শুটিংয়ের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব, আপনার পূর্ব শুটিং অভিজ্ঞতা কী বলে?চঞ্চল চৌধুরী : আমি স্পষ্ট করেই আমার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের শুটিং করতে হয় অনেক কিছু মানিয়ে নিয়ে। অধিকাংশ ডিরেক্টর বা প্রডিউসার বরাবরই শুটিং ইউনিটের নিরাপত্তা, সুস্থ জীবন যাপন ও হাইজেনিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার অবকাশ পান না। শুটিং হাউসে থাকা ঘর, বাথরুমগুলোও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না।

শুটিং স্পটের বিছানাপত্র, মেকআপ রুম কখনোই আমরা সেরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখিনি। একই বিছানার চাদর তিন মাস আগে যেমন দেখেছি, তিন মাস পরে গিয়ে আবার সেই একই চাদর বিছানো অবস্থায় দেখেছি।

শুটিং স্পটে আমাদের স্বাস্থ্যগত দিকের কথা চিন্তাই করা হয় না। করোনার সময় ‍শুটিং করলে বেশকিছু বিধি নিষেধ মানা প্রয়োজন। এসব মেনে শুটিং করতে গেলে আলাদাভাবে কিছু টাকাও খরচ করতে হবে। সেটা নাটকের বাজেটের মধ্যেই থাকতে হবে।

Advertisement

কিছু কিছু নির্মাতা আছেন যারা এখন নিজেই প্রোডিউসার। কারণ তারা টিভি চ্যানেল থেকে কন্টাক্টে কাজ নেন, কখনো টিভি চ্যানেল থেকে সরাসরি কাজ নেন আবার কখনো প্রডিউসারের মাধ্যমে ভায়া হয়েও কাজ নেন।

যিনি কন্টাক্টে কাজ নেন তার চিন্তাও কিন্তু টাকা বাঁচানোই থাকে। প্রতিদিন ৫০০ টাকা বাঁচাতে পারলে সেটাই তার জন্য বড় কিছু। অধিকাংশ নির্মাতা এটাই করেন। হাতেগোনা কিছু সচেতন নির্মাতা আছেন, তবে তাদের সংখ্যাটা খুবই কম।

জাগো নিউজ : তাহলে উপায় কী? চঞ্চল চৌধুরী : দেখেন, এখন এই দুর্যোগের সময় শিল্পী ও শুটিং ইউনিটের সবার স্বাস্থ্যের কথা ভাববেন, এমন নির্মাতা-প্রযোজক আমি পাব তার নিশ্চয়তা কি? কেউ যদি সেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিংয়ের ব্যবস্থা করেন তাহলে ভিন্ন কথা।

স্বাস্থ্যবিধি আসলে কীভাবে হয়? স্বাস্থ্যবিধি মেনে কি আসলে শুটিং করা যায়? পাঁচ হাত দূরে থেকে দাঁড়িয়ে কি অভিনয় হয়? এখন যারা কাজ করছেন তারা আর্থিক সংকট থেকে বেঁচে থাকতে কাজে যাচ্ছেন। এটা একেবারেই তাদের ব্যাপার- এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না।

জাগো নিউজ : শুটিংয়ে ফেরার আহ্বান জানিয়ে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, আপনি কী সেই চিঠি পেয়েছেন?চঞ্চল চৌধুরী : শুটিংয়ে ফেরার আহ্বান জানিয়ে আরটিভি যে চিঠি দিয়েছে, আমি সেই চিঠি পেয়েছি। তবে এখনই শুটিং করতে যাচ্ছি সেরকম নয়। তবে সবকিছু বিবেচনা করে যদি মনে হয়, শুটিং করা যাবে, তাহলে হয়তো ফেরা হতেও পারে। তবে নিশ্চিত ভাবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

জাগো নিউজ : এই সময় শুটিং করলে কোন বিষয়গুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন? চঞ্চল চৌধুরী : শুটিং করতে গিয়ে আমি যে সুরক্ষিত ব্যবস্থা পাব তার নিশ্চয়তা আগে আমাকে দিতে হবে। আরেকটা কথা এখানে আবারও বলতে চাই-এখন মানুষ কাজ করতে যাচ্ছে শিল্পের জন্য না যতটা, তার থেকে বেশি বেঁচে থাকার তাগিদে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা শুটিং করছেন তারা আলটিমেটলি, বেঁচে থাকার জন্যই করছেন।

এক্ষেত্রে আমি বলবো শুটিংয়ের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শুটিং ইউনিটের প্রত্যেকটা মানুষের সুস্থতা-অসুস্থতার দায় প্রযোজক বা নির্মাতাকে নিতে হবে। কেউ অসুস্থ হলেও তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

এখন শুটিং করলে অবশ্যই বাড়তি কিছু খরচ হবে। ইউনিটের প্রত্যেকের জন্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পুরো ইউনিট তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন হয় সেগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। একটা শুটিং স্পটে যতো শিল্পী-কলাকুশলী থাকেন তাদের প্রত্যেকের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য কয়েক হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতেই হবে। এই খরচটা কে করবে?

এখানে আরও অনেকগুলো বিষয় যুক্ত আছে। যেমন- শুটিংস্পটে যা কিছু আমরা ব্যবহার করছি শুটিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সব আবার আগের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হবে। যে শুটিং হাউসে আমরা শুটিং করব সেই হাউস এই দায়িত্ব নেবে নাকি প্রডিউসার দায়িত্ব নেবে!

আরেকটা বিষয় হলো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টাকার জন্যেই তো শিল্পীরা কাজ করছেন। তাই শুটিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিটের সবার সম্মানি পরিশোধ করতে হবে। শুটিং শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে প্রত্যেকের পেমেন্ট ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে হবে।

জাগো নিউজ : নাটক নির্মাণ বন্ধ থাকলে তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই, তাই না?

চঞ্চল চৌধুরী : ছয় মাস এক বছর শুটিং না হলে, মানুষ নাটক না দেখলে, জাতির খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমরা যারা অভিনয় করি। নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি। শিল্পের পাশাপাশি এটাতো আমাদের রুটি-রুজি। এটা করেই আমরা বাঁচি। এক বছর নতুন নাটক নির্মাণ না হলে দর্শক মরবে না, শিল্পীই হয় তো মরবে। তাই বাঁচার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুটিং করতে যাচ্ছেন অনেকেই।

জাগো নিউজ : শুটিং করলেও বিপদ, না করলেও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর সমাধান তাহলে কী হতে পারে? চঞ্চল চৌধুরী : এখন ফ্যাক্টর হচ্ছে বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকাটাই যেহেতু মুখ্য, বাঁচার জন্যই যেহেতু শুটিংয়ে ফেরা সেহেতু শিল্পীদের যেমন অভিনয়ে জন্য চ্যানেল আহ্বান জানিয়েছে, একইভাবে নির্মাতা ও প্রযোজকদের চিঠি দিয়ে জানানো হোক- তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং ইউনিটের সবার স্বার্থের কথা চিন্তা করে শুটিং করবেন কি না! কারণ আমাদের পূর্ব শুটিং অভিজ্ঞতা ভালো না। যারা নিয়ম মেনে করবেন তাদের সংখ্যাটা খুব কম।

লক্ষ করা যায় কোনো নাটকে তথাকথিত কিছু শিল্পীর উপস্থিতি না থাকলে সেসব নাটক এজেন্সি কিনতে চায় না! এই সংকটের সময় এমন মানসিকতা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে।

আরটিভি শিল্পীদের কাছে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগটাকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু এসময় সব নিয়ম মেনে শুটিং করতে যে বাজেট লাগবে সেটা কী প্রযোজক খরচ করবেন! সব মিলিয়ে কিন্তু করোনার ঝুঁকি থেকেই যায়।

এমএবি/এলএ/পিআর