সাহিত্য

রাজন ভট্টাচার্যের কবিতা

 

জলঘাট

Advertisement

থৈ থৈ বর্ষার জলমোহনগঞ্জের ট্রলারঘাটে এখন রাজ্যের ব্যস্ততাযাত্রীর জন্য হাঁকডাক চলছে তো চলছেই...দেখা হলো ইন্নস কাকুর সঙ্গেআমাদের বাড়ির পাশেই তার বাড়িনিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী তিনি যুগ যুগের। ট্রলার চেপে যাত্রা শুরু ধর্মপাশার চার নং সুখাইড় রাজাপুর ইউনিয়নের ঠাকুর বাড়ির উদ্দেশে...পাতার বিড়ি হাতে বারবার সুখটান ইন্নস কাকারশুদ্ধ আর আঞ্চলিক মিলিয়ে সুন্দর কথা বলেন তিনিগুল আর পানে লাল-খয়েরি দাঁতে কেন জানি হাসছেন... বারবার...‘বেডা তোর মনে আছেনি... বাড়ির কথা...’‘আছে তো কাকা...’‘কি মনে আছে ক... দেহি...’‘অনেক কিছু... একটু পর বলছি...’

মুক্ত বাতাসের লোভে ছাদে উঠে আমাদের যাত্রা...হাসিমুখে ঢেউ বারবার বাড়ি খাচ্ছে পানিতে ডুবন্ত আর ভেসে থাকা কাঠে;নদীর পাড়ে বাড়ির ঘাটে ঢেউয়ের তালে তালে ছন্দে মাতে কিশোরীর আধডোবা কলসমুখ ভেঙচি কাটতেই হেসে যেন কুটিকুটি শিশুদের দল। কথা বলতে বলতে নদী ছাড়িয়ে হাওরের বুক চিড়ে চলছে ট্রলারযাক... নাকে আসে ঘাস আর সদ্য পানিতে ডুবন্ত ধান গাছের পচা গন্ধ কোথাও ঘোলা, কোথাও নীল স্বছ পানিতে নবীন মাছের ছোটাছুটিছোট বড় ঢেউ আসে মেঘ আর ঝড়ের বার্তা নিয়ে।বালিহাঁসগুলো আপন মনে ছুটে চলে দূর-দূরান্তেছোট ছোট নৌকায় চলে মাছ ধরাঅন্যপাশে আকাশ যেন কালো হয়ে মিশে গেছে হাওরের জলেস্বচ্ছ নীল জমিন চাদর বিছিয়ে আছে পানির তলদেশজুড়ে।আপন মনে বৈঠা হাতে গেয়ে চলেন মাঝি, ভাঁটির গানদূর থেকে কানে বাজে ধামাইলের তাল-শব্দশিকারের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে বক আর মাছরাঙাচিলের থাবায় সতর্ক হয়ে চলে কালি বাউসের দল।হিজল গাছগুলো নাক গজিয়ে থাকে পিঁপড়া আর পাখিদের আশ্রয়েপানির নিচে ঘাঁপটি মেড়ে বেঁচে থাকে বনতুষি... খানিক পর পর দেখা মেলে গ্রামপূর্ণিমা রাতে পানিতে দোল খায় বাড়ি-ঘরফের হারিয়ে মাঝ হাওরে যেন সমুদ্রের হাতছানি। নৌকা ঘেঁষে যায় ভাঙা ঘর-বাড়ি, কলাগাছভেসে থাকা পলিথিনে মোড়ানে খয়েরি টিপের পাতা হয়তো কোন সদ্য বিবাহিতার...সাঁতরে খাল পাড়ি দিয়ে ‘চরে’ ওঠে খাবারে মহাব্যস্ত পশুর পালখাবার রেখে রাখালের দল মেতে ওঠে মার্বেল খেলায়...ছোট ছোট বাজার থেকে আসে চায়ের চুলোতে থাকা আধাকাঁচা কাঠ পোড়া ঘ্রাণবাড়ি আর আঙিনায় মজুত করা ঘর দ্বীপ হয়ে হাতছানি দেয় দূর থেকে শিশুরা ইচ্ছেমতো সাঁতার কেটে লাল চোখে বাড়ি ফেরে বেলা অবেলা...ডুবে থাকা স্কুলগুলো আছে ফের কোলাহলমুখর হওয়ার অপেক্ষায়বাড়ির আঙিনায় শুকানো কাঁচামরিচ, নানা পদের ডালের ঘ্রাণ অগোচরে বাড়ি দিয়ে যায়।

দেখতে দেখতে অনেক সময় গেলকাকা বললেন, ‘কি রে বেডা... কিছতা কছ না...মনে আছেনি?... তোদের বাড়ির সামনে রাত দিনের আড্ডার কথাকত পণ্ডিত মানুষের চলাচল ছিল, টোল বসত নিয়মিতআসতেন গায়ের অনেকে, বিচার সালিশ হতোহতো রাতভর ধানের কাজ,বিশাল বিশাল ডেগে নামত ভাত, খিঁচুরিঘণ্টাব্যাপী চলত খাওয়া-দাওয়া... উৎসবমুখর ছিল রাত-দিন।বর্ষা শেষে বীজধান নষ্ট হয়ে গেলে খুব মেজাজ করতেন তোর দাদাপূর্ণিমা রাতে সবাই মিলে গল্প হতো বাড়ির ঘাটেচাল আর চিড়া ভাজা, আহ...মাঝে মাঝে সাপ দেখে চিৎকার করতেন তোর বড় পিসিমাআমি লাঠি নিয়ে দৌড়াতাম...কখনও গায়ে বাড়ি না লাগলে তিনি বলতেন,‘বাড়িত গিয়া সাপটি মরবো... রে...’ওই দেখ একটা জঙ্গলএটাই তোদের বাড়ি...বাড়িডার চারদিকে খা খা করে... মানুষ নাই রে... কেউ থাহে না...গিয়াতি যারা আছে, না থাকার মতোইখসে খসে পড়ছে ঘরগুলোর দেয়ালের পলেস্তারামন্দিরগুলো এখন সাপ আর বটের আখড়াপুরোনো ঘরগুলোর কোন স্মৃতি চিহ্ন নেইএত বড় বাড়ির সবচেয়ে ঐতিহ্য গোলা ঘর এখন শূন্যভিটেও ভেসে গেছে পানিতে নেই কাজের লোক, বাড়ি আর গমগম করে না। ধানি জমির মালিক এখন অন্যেরা...ভরাট হয়ে গেছে পুকুরবিক্রি হয়েছে প্রায় সব জমিসামনের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে থাকা উজাড় হয়েছে বন প্রতিবছর ভাঙতে ভাঙতে ৪০ বিঘার বাড়ি দুই বিঘায় ঠেকেছে।...শত কষ্টের মধ্যে বিদায় নিয়েছেন তোর ঠাকুরদা, কাকাচোখের জলে অন্যের ঘরে গেছেন তোর চার পিসিওরা আর আসে না... মন কাঁদে রে সবার জন্য... যোগাযোগ আছে তারার লগে...’ ‘আছে কাকা...’‘একটু সামনের দিকে দেখ...ভেঙে খানখান হয়েএখন নামমাত্র আছেএটাই তোদের বাড়ির সেই ‘জলঘাট’এখনও বর্ষায় সেখানেই প্রতিদিন ট্রলার থামে...ওই বাড়িতে এখন আর যাত্রী হয় না রে...’

Advertisement

এসইউ/পিআর