সম্প্রতি আমার এক ভুটানিজ বন্ধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছে: ভারতীয়রা ভুটানের সীমান্ত অতিক্রম করে বিভিন্ন উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। ভুটানের ওই এলাকার মানুষ পানির সংকটে রয়েছে। ভারতীয়দের সীমান্ত অতিক্রম করে ভুটানিদের পানির উৎস থেকে পানি সংগ্রহের ফলে ওই সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। আমার ওই বন্ধুকে যতটুকু জানি তা থেকে নিশ্চিত যে তার মধ্যে ভারতবিরোধিতা নেই।
Advertisement
অথবা ভারতের শত্রুরাষ্ট্র চীন বা পাকিস্তানের সে অন্ধ সমর্থক নয়। বরং তার সাথে যখন কথা বলেছি ভারত এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে এক ধরনের ভালোলাগা আছে তা প্রকাশে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখিনি। তাই আমার বন্ধুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই পোস্ট থেকে আমি অনেক বড় বার্তা পেয়েছি। ওই বার্তার সারমর্ম হলো নেপালের মতো ভুটানেও ভারতবিরোধিতা দানা বাঁধছে। শুধু জনগণ নয়, ভুটানের চেকপোস্টে চীনা সৈন্যদের নিয়মিত অবস্থানও বলছে ভুটানের সরকারও ধীরে ধীরে চিন বলয়ে চলে যাচ্ছে।
চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোয় ভারতবিরোধিতা বাড়ছে তা যতটা সত্য তার চেয়ে বড় সত্য ভারতের প্রতিবেশী নীতি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকার রাখছে। ভুটানি সাধারণ মানুষের ওই ক্ষোভ যদি ভারতীয় জনগণ এবং ভারত সরকার আমলে না নেয় তাহলে ভবিষ্যতে ভুটানও হয়তো পুরোপুরি ভারতবিরোধী বলয়ে চলে যাবে। আজকের নেপালের যে ভারতবিরোধী অবস্থান তা একদিনে তৈরি হয়নি।
ভুটানের মতোই নেপালের জনগণ দেখেছে ভারতীয়রা দিনের পর দিন তাদের সীমান্ত অতিক্রম করেছে। নেপালের জনগণকে বন্ধুত্বপূর্ণ মর্যদা না দিয়ে ভারত নেপালকে শাসন করার চেষ্টা করেছে। ভারতের এমন নীতির কারণ ছিল: ভারত ধরেই নিয়েছিল, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক মিল থাকায় এবং নেপালের নিজস্ব কোনো সমুদ্রবন্দর না থাকায় বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের জন্য একমাত্র ভারতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় নেপালের পক্ষে কখনও ভারতকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে নেপালিদেরকে বন্ধু হিসেবে সম্মান না করে ভারত সবসময় শাসন করার চেষ্টার ফল আজ পাচ্ছে।
Advertisement
চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান এবং নেপালের রাজনৈতিক পরিবর্তন অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে নেপালের নীতি পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক নেপালের সংসদে উচ্চ ও নিম্নকক্ষে সর্বসম্মতভাবে নেপালের মানচিত্র পরিবর্তন এই বার্তা দেয় যে নেপালি জনগণও ভারতবিরোধী হয়ে পড়েছে। তাই বিরোধী দলও ভারতপন্থী হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থে ও জনসমর্থন ধরে রাখতে ভারতবিরোধী বিলে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে।
ভারত সরকারকে ভাবতে হবে, নেপালি জনগণের ওই ভারতবিরোধী মনোভাব একদিনে তৈরি হয়নি। ভারত সরকারের দীর্ঘদিন নেপালের জনগণের মনোভাবকে উপেক্ষা করে ভারতপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় রাখার যে নীতি নেপালে বলবৎ রেখেছিল তার নেতিবাচক ফল হচ্ছে আজ নেপাল ভারতের শত্রুরাষ্ট্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। নেপালের সাথে সীমান্ত বিরোধ আপাতত মীমাংসা হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। বরং নেপাল যদি তার মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত এলাকার ওপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে তার দখল বলবৎ করতে যায় তাহলে ভারতের সাথে সামরিক সংঘাত অনিবার্য। আর একবার সামরিক সংঘাত হলে পাকিস্তানের মতো নেপালও ভারতের স্থায়ী শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হবে।
নেপাল-ভুটান ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। তামিল টাইগারকে ভারতীয় সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে শ্রীলংকার অখণ্ডতা বিপন্ন করতে চায় এমন অভিযোগ বহু পুরোনো। চীনের সহায়তায় শ্রীলংকা ভারতপন্থী সেই তামিল টাইগারদের নিশ্চিহৃ করার ফলে শ্রীলংকার জনগণের চীনের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি রয়েছে। মালদ্বীপের সরকার আংশিক ভারতপন্থী হলেও চীনের বিরোধী কোনো বক্তব্য প্রদান করার মতো অবস্থানে মালদ্বীপ নেই। চীন ঋণের জালে মালদ্বীপকে এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধেছে যে মালদ্বীপের পক্ষে চীনের বিরোধিতা অসম্ভব।
আফগানিস্তান বরাবরই পাকিস্তানপন্থী। তালেবানবিরোধী সরকার ভারতের সাথে মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা করলেও তালেবানদের সাথে আমেরিকার শান্তিচুক্তির পর আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব আরও বেড়েছে। সমরনীতিতে পাকিস্তান আর চীন হচ্ছে, একই মায়ের পেটের দুই ভাই। তাই আফগান সরকার চীনবিরোধী ভারতীয় নীতিতে ভারতকে সমর্থন করার কোনো কারণ নেই।
Advertisement
ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমার অর্থনৈতিকভাবে ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কূটনৈতিক সমর্থন লাভের জন্য চীনের ওপর এতটা নির্ভরশীল যে মিয়ানমার মেরুদণ্ড সোজা করে চীনবিরোধিতা করার সাহস পাবে না। চীনের ক্ষমতা বলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে ঝেটিয়া বিদায় করেছে। তাই তারা জানে চীনের বিরোধিতা করলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বেকায়দায় পড়ে যাবে। ফলে মিয়ানমারও চীনের বিরোধিতায় রা-টি পর্যন্তও করবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীনের সাথে লড়াইয়ে ভারত একমাত্র বাংলাদেশের সমর্থন পাওয়ার আশা করতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় এমন আশা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু ভারতের পাশাপাশি চীনের সাথেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন দেয়া ছাড়াও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় সিংহভাগই চীনা কারখানায় তৈরি। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশেরই চীনের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা আছে।
পাকিস্তানের সাথে ভারতের বিরোধিতা। আর চীনের সাথে ভারতের বিরোধিতা এক বিষয় নয়। তাই বাংলাদেশ সরকার চাইলেই সামরিক বাহিনীর ওই উল্লেখযোগ্য অংশের চীনপ্রীতিকে উপেক্ষা করে ভারতকে সমর্থন করা সম্ভব হবে না। পদ্মাসেতুসহ বাংলাদেশের প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি চীনের বেল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় বাংলাদেশের চীনের সিস্টারসিটি প্রকল্পে যুক্ত হওয়ায় এবং প্রায় বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের চীনে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কসুবিধা প্রদান করায় বাংলাদেশের সরকারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও চীনা প্রভাব বেড়েছে।
অন্যদিকে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করতে পারা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের ফলে আগেই এদেশে ভারতবিরোধিতা বেশ চাঙ্গা। চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামরিক সুবিধা প্রদান ওই ভারতবিরোধিতাকে আরও শক্তিশালী করেছে তাতে সন্দেহ নেই। ফলে বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতকে সমর্থন করা সম্ভব হবে না। আরও চীনবিরোধিতা অসম্ভব।
তবে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন লাভকে পুঁজি করে ভারত বাংলাদেশের ভারতপন্থী জনগণকে জাগিয়ে তুলে সরকারকে বাধ্য করতে পারত চীনবিরোধী অবস্থান নিতে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত হত্যকাণ্ড ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বহু আগেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি জনগণকে ভারতবিরোধী করে তুলেছে। বাংলাদেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ভারতের বিরাগভাজন না হওয়ার স্বার্থে এই সত্য কথাটি হয়তো প্রকাশ করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাব ভারত সরকার ও ভারতীয়দের অজানা বলে সাম্প্রতিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের লেখনি থেকে মনে হয়েছে।
ভারতের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার চীনের খয়রাতি সাহায্যে বাংলাদেশ বেজিংয়ের পক্ষে চলে যাচ্ছে অথবা দিল্লির প্রভাবশালী থিংকট্যাঙ্ক অবর্জাভার ফাউন্ডেশনের গবেষক জয়িতা ভট্টাচার্যের চীনের সিস্টার সিটি প্রকল্পে বাংলাদেশের যোগদান নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ থেকে তা স্পষ্ট।
প্রকৃতপক্ষে, ভারত সরকারের আংশিক সফল কূটনীতি তথা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জনগণের মনোভাব উপলব্ধি করে জনগণের সাথে সর্ম্পক স্থাপন না করে সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের নীতির ফলেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। ভারতপন্থী সরকার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে ওই রাষ্ট্রের সাথে ভারতের দীর্ঘ বৈরিতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ভারত যদি সরকারের বদলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন ওই দেশের সরকারের পক্ষে ভারতবিরোধিতা সম্ভব হবে না।
চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমাতে সাহায্য করছে সত্য। কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য ভারতের আংশিক সফল কূটনীতি জনগণকে রেখে সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন চীনকে বেশি সুবিধা করে দিচ্ছে। ভারত সরকার তার কূটনীতি পরিবর্তনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে সীমান্তে যেকোনো সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার নীতি গ্রহণ করে ওপরের দাবির সত্যতা যাচাই করে দেখতে পারে। এই একটি নীতিই বাংলাদেশের জনগণের ভারতবিরোধী হওয়া থেকে বহুলাংশে বিরত রাখবে।
অন্যথায় আজ হয়তো ভারতবিরোধী চীনা সামরিক জোটে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে নেপালের মতো বাংলাদেশও ভারতে সাথে সামরিক সংঘাতে জড়ালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভারত তার সীমান্ত নীতি পরিবর্তন না করলে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় নেপাল হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। ভারত সরকার ও তার জনগণের সেই বাস্তবতা বুঝে বাংলাদেশে নীতি নির্ধারণ করা উচিত।
পরিশেষে, চীনকে দায়ী না করে অথবা চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো চীনের কবজায় চলে যাচ্ছে এমন অভিযোগ না করে ভারতের উচিত নিজের আয়নায় নিজের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি গৃহীত নীতি পর্যালোচনা করা।
লেখক : সামরিক ইতিহাস গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম