*** করোনা রোগীর সেবা দিয়ে তিন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত*** লিভারের রোগী হয়েও করোনায় সেবা দিয়েছেন এক চিকিৎসক*** এক রুমে আক্রান্ত চিকিৎসক অন্য রুমে জ্বরে আক্রান্ত স্ত্রী-সন্তান*** এরই মধ্যে এক চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন*** করোনাযুদ্ধে লড়ছেন অন্য চিকিৎসকরা
Advertisement
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বরিশালের তিন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে মৃত্যুকে তুচ্ছ ও ভয়কে জয় করে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। তাদের মধ্যে দুইজন বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছেন। একজন সুস্থ হয়ে পুনরায় কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন চিকিৎসক হলেন- বরিশাল সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যতীন চন্দ্র রায়, বানারিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এসএম কবির হাসান ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রমিজ আহমেদ। তাদের মধ্যে এসএম কবির হাসান ও রমিজ আহমেদ করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছেন।
বরিশাল সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, সদর উপজেলায় ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও আটটি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যতীন চন্দ্র রায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে ওসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রোগীদের সেবা নিশ্চিতে নিয়মিত তাকে তদারকি করতে হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্য দেখা দিলে ছুটে গেছেন যতীন চন্দ্র রায়। দাফতরিক কাজের বাইরেও সপ্তাহের ৩-৪ দিন ওই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনে যেতে হয়েছে তাকে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর বর্তমানে নিজ বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন যতীন চন্দ্র।
Advertisement
আইসোলেশনে থাকা বরিশাল সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যতীন চন্দ্র রায় বলেন, ২৬ মে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পর শরীর খারাপ লাগছিল। বিকেলে বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিই। সন্ধ্যার পর জ্বর আসে। এর সঙ্গে শুরু হয় গলাব্যথা। করোনা সন্দেহে ৩০ মে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাই। ৩১ মে সেখান থেকে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তারপর থেকে বাসায় আইসোলেশনে।
চিকিৎসক যতীন চন্দ্র রায় বলেন, বছর দেড়েক আগে লিভার ক্রনিকে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এরপর থেকে চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। লিভার ক্রনিক থাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে চলার নির্দেশনা ছিল চিকিৎসকের। তবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য তা মানা সম্ভব হয়নি। সেজন্য পরিবারের সদস্যরা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এখন জ্বর থাকলেও আগের থেকে অনেকটা সুস্থবোধ করছি। দুই-তিনদিন পর নমুনা পরীক্ষা করাব।
ঠিক তারই মতো করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছেন বানারিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক এসএম কবির হাসান। তিনি বর্তমানে বরিশাল নগরীর বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন।
আইসোলেশনে থাকা চিকিৎসক এসএম কবির হাসান বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ ১৪ জুন জ্বর, গলাব্যথা শুরু হয়। সঙ্গে বমি হচ্ছিল। ১৭ জুন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ল্যাবে নমুনা দেই। ১৮ জুন রিপোর্ট পজিটিভ আসে।
Advertisement
এসএম কবির হাসান বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৈনিক ৪০-৫০ জন রোগী আসছেন। এর মধ্যে গড়ে ২০ জন রোগী আমাকে দেখতে হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন দুটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এ পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচজন করোনা রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এর মধ্যে তিনজন জুন মাসের শুরুর দিকে ভর্তি ছিলেন। তাদের কাছে গিয়ে সেবা দিতে হয়েছে।
কিভাবে আক্রান্ত হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে কবির হাসান বলেন, আক্রান্ত হওয়ার আগে গত তিন মাসে হাসপাতালের বাইরে পা রাখিনি। টানা দায়িত্ব পালন করে গেছি। আক্রান্তের কয়েকদিন আগে করোনাসহ নানা উপসর্গের রোগীদের দেখতে হয়েছে। সেখান থেকে সংক্রমিত হয়েছি।
কবির হাসান বলেন, জ্বর না থাকলেও এখন মাথাব্যথা ও দিনে বেশ কয়েকবার বমি হচ্ছে। খাবারের স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছি না। তবে নিজেকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি না। বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছি। বাসার অন্য কক্ষে পাঁচ বছরের মেয়ে ও নয় বছরের ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী থাকছেন। গত দুইদিন ধরে মেয়ে ও স্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত। প্রতিটি মুহূর্ত খুব দুশ্চিন্তায় কাটছে। মনে হয় আমার কারণে তারা আক্রান্ত হয়নি তো। এই আতঙ্কে থাকছি সবসময়। সবার কাছে দোয়া চাই; যেন সবাই করোনা থেকে দ্রুত সুস্থ হতে পারি।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কর্মকর্তা চিকিৎসক রমিজ আহমেদের গল্পটা প্রায় একই রকম। চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হলেও দমে যাননি তিনি। সাহস, ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে সুস্থতার জন্য লড়াই করে গেছেন। টানা ২০ দিন লড়াইয়ের পর এখন তিনি সুস্থ। কর্মস্থলে যোগ দিয়ে পুনরায় রোগীদের সেবা দিচ্ছেন তিনি।
চিকিৎসক রমিজ আহমেদচিকিৎসক রমিজ আহমেদ বলেন, আক্রান্তের আগে বিভিন্ন উপসর্গের রোগী দেখতে হয়েছে। কার করোনা আছে কার নেই, এটা জানা ছিল না। হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকা কয়েকজন রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়েছে। সেবা দিতে গিয়ে রোগীদের কাছাকাছি গেছি। হয়তো তখন সংক্রমিত হয়েছি।
তিনি বলেন, ২৬ মে মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হই। দুইদিন পর শরীরব্যথা ও কাশি দেখা দেয়। করোনার উপসর্গ দেখে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাই। ৩১ মে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এর আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ৩০ মে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই।
রমিজ আহমেদ আরও বলেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ২০ দিন নিয়ম মেনে সবকিছু করেছি। বেশি করে ভিটামিন-সি ও ডি-যুক্ত খাবার খেয়েছি। প্রতিদিন কয়েকবার গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করেছি। আদা-লবঙ্গ দিয়ে তিন-চারবার করে রং চা পান করেছি। ব্যায়াম চালিয়ে গেছি। দৃঢ়তার সঙ্গে করোনাকে মোকাবিলা করেছি। চিকিৎসক সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরাও আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। প্রথমবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ আসে। সবার দোয়ায় ১৭ জুন সর্বশেষ ফলোআপ রিপোর্টও নেগেটিভ আসে। গত ১৮ জুন থেকে পুনরায় রোগীদের চিকিৎসায় মনোযোগ দিয়েছি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানবতার সেবায় যেন নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারি, সেটিই আমার প্রত্যাশা।
বরিশালের সিভিল সার্জন চিকিৎসক মনোয়ার হোসেন বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের ১৬১ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জন চিকিৎসক ও ৮৭ জন সেবিকা ও ৪৬ জন কর্মচারী রয়েছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সরকারি সদর (জেনারেল) হাসপাতালের একজন চিকিৎসক মারা গেছেন। এরপরও জেলায় কর্মরত স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল অটুট রয়েছে। তারা জেনেশুনে এই কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করে যাচ্ছেন। যেন হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত না হয়।
এএম/এমকেএইচ