দেশজুড়ে

একের পর এক দুর্যোগে দিশেহারা সুন্দরবনের পেশাজীবীরা

আইলা, সিড়র, ফণি, বুলবুল ও সাম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। একের পর পর প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা সুন্দরবন কেন্দ্রিক পেশাজীবীরা। একটি দুর্যোগের পর বিধ্বস্ত হয়ে পূনর্বাসিত হওয়ার আগেই আরেকটি দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও জীবিকার উপর প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল উপকূলীয় অঞ্চলের এসব পেশাজীবীদের।

Advertisement

সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন ভুরুলিয়া ইউয়নের কাটিবারহল গ্রামের বাসিন্দা আনিসুর রহমানের ছেলে আব্দুর রহমান। তিনি সুন্দরবনের ফুল থেকে মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করেন। সুন্দরবন উপকূল নীলডুমুর বাজার এলাকায় মৌমাছির ১৯৫টি বাক্স পেতেছিলেন মধু সংগ্রহ করতে। তবে সাম্প্রতি ঘটে যাওয়া আম্ফানে ও বাঁধ ভেঙে নদীর পানিতে ভেসে গেছে ১০০ মৌমাছির বাক্স। হারিয়েছেন মৌমাছিও। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন এই মৌচাষী।

মৌচাষী আব্দুর রহমান জানান, ঝড়ের রাতে বাঁধ ভেঙে যায়। একদিকে ঝড় আরেকদিকে বাঁধ ভেঙে তীব্র গতিতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এতে আমার ১০০ মৌমাছির বাক্স পানিতে ভেসে হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাওয়া বাকি ৯৫টি মৌমাছির বাক্সেও মৌমাছি মারা গেছে। প্রত্যেকটি বাক্সের মূল্য তিন হাজার টাকা। তিন লাখ টাকা নষ্ট হয়ে পথে বসেছি। অথচ আমাদের নিয়ে সরকারি কোনো দফতরের চিন্তা নেই, কেউ এখনো খোঁজও নেয়নি।

বন বিভাগের তথ্য মতে, সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় সুন্দরবনের নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরা, সুন্দরবনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করা, কাকড়া আহরণ ও গোলপাতা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৮ হাজার ৪৭০ উপকূলীয় বাসিন্দা। এর মধ্যে সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) রয়েছে ১০২০টি। প্রতি বিএলসিতে রয়েছেন তিনজন জেলে। মোট মাছ ধরা জেলে রয়েছেন ৩০৬০ জন। কাকড়া ধরার জন্য বিএলসি রয়েছে ১৭৯০টি। প্রতি বিএলসিতে দুইজন জেলে। মোট রয়েছেন ৩৫৮০ জন। এছাড়া মধুর বিএলসি রয়েছে ২৬০টি। প্রতি বিএলসিতে মৌয়াল ৬ জন। সে হিসেবে মোট মৌয়াল ১৫৬০ জন। তাছাড়া সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহ করার জন্য রয়েছে ৪৫টি বিএলসি। প্রতি বিএলসিতে ৬ জন। গোলপাতা সংগ্রহ করেন ২৭০ জন।

Advertisement

সাম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল এসব পেশাজীবী মানুষ। কারো নদীতে মাছ ধরার জাল নষ্ট হয়ে গেছে, কেউবা হারিয়েছেন নৌকা, সম্বল হারিয়েছেন মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালরা, কেউ হারিয়েছেন মাথা গোজার ঠাঁই। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অধিকাংশ বনজীবী।

২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল ফণি, ওই বছরের ৯ নভেম্বর বুলবুল ও সবশেষ গত ২০ মে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাত। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এসব বনজীবীরা।

উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, গাবুরা ইউনিয়নে পাঁচ হাজার মৎস্যজীবী রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ও আম্ফান পরিস্থিতিতে এদের প্রত্যেককে ৫৬ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি এনজিও সংস্থা কারিতাসের পক্ষ থেকে ২০০ মৎস্যজীবীকে ২০ হাজার ৩০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সুশীলন এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে ৪ হাজার টাকা করে এক হাজার মৎস্যজীবীকে দেওয়া হচ্ছে।

সাতক্ষীরা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, সুন্দরবনের বনজীবীদের সহযোগিতার ব্যাপারে আমরা কোনো উদ্যোগ নিতে পারি না। জেলা প্রশাসনের মিটিংয়েও তাদের সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা করা সম্ভব হয় না। কারণ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলেদের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। বনবিভাগের কাছে চাইলেও তারা দেয় না। একটি তালিকা পেলে তাদের সহযোগিতার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হতো। তবে জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় ৩১ হাজার মৎস্যজীবী রয়েছেন। তাদের জন্য করোনা ও আম্ফান পরিস্থিতিতে সরকার ৫৬ কেজি করে চাল সহায়তা দিয়েছে।

Advertisement

তিনি বলেন, ২০ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ থাকায় তারা এ সহযোগিতা পাচ্ছেন। প্রথম পর্যায়ে ৩৫ দিনের খাদ্য সহায়তা হিসেবে ৫৬ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আরও ২৩ দিনের চালও তারা পাবেন। তবে এই ৩১ হাজার মৎস্যজীবীর তালিকার মধ্যে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা আছেন কিনা সেটি যাচাই করার সুযোগ আমাদের নেই। কেননা সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের তালিকা আমাদের কাছে নেই।

সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক আবুল হাসান জানান, সাতক্ষীরায় সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল বনজীবী রয়েছেন আট থেকে দশ হাজার। বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) রয়েছে তিন হাজার। এদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বনজীবীদের সহযোগিতার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। এছাড়া মৎস্য দফতর থেকে আমাদের কাছে কোনো তালিকা চাওয়া হয়নি। তবে আমরা বনজীবীদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করছি।

খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশির আল মামুন বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই জেলে বাওয়ালীদের প্রবেশে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতার জন্য বনবিভাগের কর্মীরা কাজ অব্যাহত রেখেছে। প্রত্যেক জেলেকে আমরা কাউন্সিলিং করেছি। যারা বনে যেতে ইচ্ছুক তারা যেতে পারছেন। তবে করোনা ও আম্ফানে বনে প্রবেশের সংখ্যা কমে গেছে।

আকরামুল ইসলাম/এফএ/এমএস