বিশেষ প্রতিবেদন

অস্তিত্ব সংকটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনেমা হলগুলো

৯০ এর দশকে সংস্কৃতির রাজধানীখ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি উপজেলায় বিনোদনপ্রেমীদের জন্য একাধিক সিনেমা হল ছিল। সে সময় পরিবারের সবাই এক সঙ্গে মিলে হলে বসে ছবি দেখেছেন। ‘আলোর মিছিল, সারেং বউ, বেদের মেয়ে জোসনার মতো ঐতিহাসিক ছবিগুলো ভালো ব্যবসা করায় সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকলেও বর্তমান সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র তুলনামূলক মানসম্পন্ন না হওয়ায় আর হলের ভেতরে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলার অধিকাংশ সিনেমা হলই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে পুরো জেলা জুড়ে মাত্র ছয়টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। তবে চালুকৃত এসব সিনেমা হল কোনোভাবেই দর্শকদের হলমুখী করতে পারছে না। এর ফলে চালুকৃত হলগুলোও এখন বন্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৯টি উপজেলায় অন্তত ২০টি সিনেমা হল ছিল। কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অর্ধেকেরও বেশি সিনেমা হলই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে জেলার আশুগঞ্জ উপজেলায় ‘মেঘনা সিনেমা’, সরাইল উপজেলায় ‘বিনোদন’, আখাউড়া উপজেলার ‘মায়াবী’, নবীনগর উপজেলায় ‘নুপুর’, বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ‘শিল্পী মিলন সিনেমা’ এবং কসবা উপজেলায় ‘বসুন্ধরা’ নামে একটি করে সিনেমা হল চালু রয়েছে। কিন্তু চালুকৃত এসব সিনেমা হলে দর্শকদের বসার আসনগুলো ভাঙা, নেই পর্যাপ্ত পাখা কিংবা আলোক সজ্জার ব্যবস্থা। বর্তমানে দেশে ডিজিটাল ফর্মেটের ছবি তৈরি হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসব সিনেমা হলগুলোতে সেই মান্ধাতা আমলের পর্দাতেই দেখানো হয় সিনেমা। এছাড়া হলে দর্শক টানতে কিছু অসাধু হল মালিক প্রায়ই হলে অশ্লীল সিনেমা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের দর্শকরা এখন আর হলে গিয়ে ছবি দেখছে না। এর কারণ হিসেবে সিনেমা হলগুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবকেই দায়ী করেছেন অনেকে।নতুন প্রজন্মের কয়েকজন দর্শক জাগো নিউজকে জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনেমা হলগুলোতে পরিবারের সব সদস্য মিলে একসঙ্গে বসে ছবি দেখার কোনো পরিবেশ নেই। হলের ভেতরে দর্শকদের আসনগুলো ভাঙা, মেঝেতে সব সময় নোংরা থাকে। তাছাড়া হল মালিকরা অধিক মুনাফার আশায় হলে অশ্লীল ছবি চালান। এতে করে যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে।তবে সংস্কৃতি বোদ্ধাদের মতে, বর্তমানে দেশে সৃজনশীল ছবি তৈরি না হওয়ায় দর্শকরা হলে গিয়ে ছবি দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর ফলে এক শ্রেণির অসাধু হল মালিক শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে অশ্লীল ছবি চালান।এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের পরিচালক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মো. মনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দেশে এখন আর আগের মতো সৃজনশীল ছবি তৈরি হচ্ছে না। এর ফলে প্রতিযোগিতার বাজার না থাকায় কিছু অসাধু হল মালিক মুনাফার আশায় অশ্লীল ছবি চালান। এতে করে তরুণ প্রজন্মের দর্শকরা এখন আর হলে গিয়ে ছবি দেখছে না। তাই দিন দিন সিনেমা হলের সংখ্যা কমে আসছে। তবে সিনেমা হলগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।এদিকে হলে যেতে না পেরে অনেক নারী দর্শকরাই ঝুঁকে পড়েছেন স্টার প্লাস, স্টার জলসা কিংবা জি বাংলার মতো ভারতীয় জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলোর দিকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিনোদন লাভের আশায় তারা ভারতীয় এসব চ্যানেল দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এতে করে আমাদের দেশীয় বিনোদনভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলো এখন হুমকির মুখে। কয়েকজন সিনেমা হল মালিকের সঙ্গে কথা হলে তারা জাগো নিউজকে জানান, আমাদের দেশে এখন মানসম্পন্ন ছবি খুব কম তৈরি হচ্ছে। এর ফলে তুলনামূলকভাবে ভারতীয় বাংলা ছবি মানসম্পন্ন হওয়ায় দর্শকরা এখন সিডি কিনে ঘরে বসেই ভারতীয় বাংলা ছবি দেখেন। এতে করে দর্শকরা হলে না আসায় লোকসান গুণতে হচ্ছে হল মালিকদের।

Advertisement

আখাউড়ার মায়াবী সিনেমা হলের সত্ত্বাধিকারী শিপন হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ভারতীয় বাংলা সিনেমার কারণে বাংলাদেশি সিনেমা ব্যবসায় ধস নেমে আসছে। তাছাড়া এখন নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পাওয়ার দুই-তিন দিনের মধ্যেই সেটি ইন্টারনেটে চলে আসছে। এ কারণে দর্শকরা হলে সিনেমা দেখতে না আসায় হল মালিকদেরকে লোকসান গুণতে হচ্ছে। তবে সারাদেশের চালুকৃত সিনেমা হলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সিনেমার পাইরেসি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং স্টার প্লাস, স্টার জলসা কিংবা জি বাংলার মতো ভারতীয় বিনোদন ভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি।এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ব্যক্তিগত সিনেমা হলের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কিছু করার নেই। তবে যদি কোনো হল মালিক জেলা প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চান তাহলে তাদের অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে। তিনি আরো বলেন, কিছু কিছু সিনেমা হলে অশ্লীল সিমেনা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। আমরা সেই সকল হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে অশ্লীল সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করছি।এসএস/আরআইপি