‘যিদিন কামরুজ্জামানের ফাঁসির সাজা অইছিল, ওই দিন বুহে থাইক্কা পাত্তর চাপা কষ্টডা কিছুডা নামছিল। হাইকোর্টও ওর ফাঁসি চাই। মনে বড় আশা, মরবার আগে আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে সেই তাগোরে ফাঁসি দেইখ্যা মরবার চাই।’ -শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছতে মুছলে কথাগুলো বলেন শহীদ খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া। মুক্তিযুদ্ধে সময় তার স্বামী, সন্তান-স্বজনসহ পরিবারের ৮ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।তিনি যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার স্বামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা লইয়্যা আইয়্যা উডানে ফালাইয়্যা ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনা মানিক বুকের ধন (ছেলে) হাশেমরে ধইর্যা নিয়্যা বাপের লাশের উফরে ফালাইয়্যা গুলি করে। এর পর আমার দেওররে ধইর্যা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরান বাইরইয়্যা যায়।’মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা শেরপুরের আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় হওয়ায় শত কষ্টের মাঝেও এই স্বামী-সন্তান-স্বজনহারা বিধবার চোখে আনন্দাশ্রু ঝরেছে। এবার আপিল বিভাগের রায়েও তিনি তার ফাঁসির রায় বহাল রাখার দাবী জানিয়েছেন। তার মতোই আপিল বিভাগেও কামারুজ্জামানের ফাঁসির রার বহাল থাকবে বলে প্রত্যাশা করছেন নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের বিধবা ও শহীদ স্বজনরাসহ শেরপুরবাসী। শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগর নেতা কামরুজ্জামানের ফাঁসির সাজা কতা হুইন্না আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইছিল। অহন আফিলেও ওর ফাঁসি চাই।সেদিনের সেই হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহীদ জসিমুদ্দিনের স্ত্রী বিধবা নুরে মান বেওয়া, বিধবা সমলা বেওয়া ও করফুলি বেওয়া। তারা বলেন, পাকবাহিনীরাতো আর আমগর এলাকা চিনতো না। রেজাকার-আলবদররাইতো তাগরে পথ দেহাইয়া এই গেরামে মুক্তি আছে কইয়া আনছে, ম্যাছাকার করছে। আমগরে বিদুফা (বিধবা) করছে, স্বামী-সন্তান হারা করছে। কামরুজ্জামান আছিল ওগরে নিডার (নেতা)। অক্তের (রক্তের) বদলে কামরুজ্জামানের অক্ত (রক্ত) নেওয়ার ফাঁসির সাজাই আমরা চাই। শহীদ ছফির উদ্দিনের দুই ছেলে জালাল উদ্দিন ও আলাল উদ্দিন বলেন, কামরুজ্জামানের ফাঁসি ছাড়া আর কোন সাজা নাই। আমরা অপেক্ষায় আছি, কহন কামরুজ্জামানের ফাঁসি হয়।১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বর্বর পাকিন্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় জেলা শহর শেরপুর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. দুরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের ৬ ঘন্টার তান্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাকবাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষদের। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবা পল্লী’। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের নির্দেশে সোহাগপুর গ্রামে এ গণহত্যা সংগঠিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে এই সোহাগপুরে মানবতাাবরোধী অপরাধের ঘটনায় জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়।শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা মুদিপাড়া এলাকার বাসিন্দা জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। এই কামারুজ্জামানের এক সময়ের সহচর আত্মস্বীকৃত আলবদর শহরের নয়ানী বাজার আলবদর টর্চার ক্যাম্পের পাহারাদার মোহন মিয়া ওরফে মহন মুন্সী বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার চাইছিলাম। কিন্তু কামরুজ্জামান আমার জীবনডারে ধ্বংস কইরা দিছে। ওই আমারে ধইরা নিয়া আলবদর ক্যাম্পের পাহারাদার বানাইছে। আমার জীবনডারে ধ্বংস করছে, আমি ওর শেষ দেকপার চাই। কাদের মোল্লার ফাঁসি দেকছি। অহন কামরুজ্জামানের ফাঁসিও দেইক্কা মরবার চাই।এদিকে, শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই মোশাররফ হোসেন, সেক্টর কমান্ডারস ফোরম শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট প্রদীপ দে কৃষ্ণ, কামারুজ্জামানের মামলার সাক্ষী বীর প্রতীক বার জহুরুল হক মুন্সী বলেন- আশা করছি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় আপিল বিভাগেও বহাল থাকবে। বারবার ফাঁসিই তার জন্য উপযুক্ত সাজা। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ে গত বছরের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ৬ জুন খালাস চেয়ে কামারুজ্জামান আপিল করেন।উল্লেখ্য, আগামীকাল সোমবার মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মো. কামারুজ্জামানের আপিলের চূড়ান্ত রায় ঘোণষা করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এসএম কুদ্দুস জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
Advertisement