বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ যখন আতঙ্কিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে তখন দিন-রাত করোনাসহ সব ধরণের রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন ভোলার অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। তাদের কাছে টাকার চেয়ে সময় মতো রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটাই এখন বড় বিষয়। অবহেলা না করে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করায় মানুষের ভালোবাসাও পাচ্ছেন তারা।
Advertisement
ভোলা জেলা অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ভোলার সাত উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি মিলে ৮০/৯০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে চালক ও হেলপার রয়েছেন দুইশ জনের মত। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা সরকারিভাবে বেতন পান। আর বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও হেলপারদের ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতন দেন মালিকরা। এই টাকায় সংসার পরিচালনা করতে নানা সমস্যা থাকলেও মানুষের সেবায় সব সময় তারা নিয়োজিত রয়েছেন।
বর্তমানে করোনার কারণে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন অ্যাম্বুলেন্স চালক ও হেলপাররা। একদিকে পরিবারের বাধা অন্যদিকে সমাজের মানুষের নানান কটূক্তির শিকার হচ্ছেন তারা। তবুও মানুষের সেবায় কাজ করে চলছেন তারা।
এদেরই একজন মো. উজ্জল (৩০)। বাড়ি ভোলা পৌরসভার কাঠালিয়া ৮নং ওয়ার্ডে। বাবা-মা, স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে ও এক ছোট বোন নিয়ে তার সংসার। পেশায় একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক। গত ৮ বছর ধরে তিনি এ পেশায় রয়েছেন। র্দীঘদিন ধরে পেশায় নিয়োজিত থেকে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। বর্তমানে মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু পেশার কারণে বিভিন্ন সময় নানা সমস্যা তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
Advertisement
অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. উজ্জল বলেন, সাতজনের সংসারে একমাত্র আমিই উপার্জন করি। প্রতিমাসে মালিকের দেয়া বেতনের ওপর নির্ভর করে সংসার পরিচালনা করি। র্দীঘদিন ভালোভাবেই এ পেশায় নিয়োজিত থাকলেও বর্তমানে ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছি। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হলে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরা কেঁদে ফেলে। তারা কাজে না যাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু আমি জানি কাজে না গেলে মালিক বেতন দেবে না। আর বেতন না পেলে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। অন্য কোনো কাজও জানি না।
আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের চন্দ্র প্রসাদ গ্রামের বাসিন্দা মো. নুর ইসলামের ছেলে মো. ছালাউদ্দিন (২৯)। বাবা-মা, তিন বোনসহ ছয়জনের সংসার তার। পরিবারের আয়ের একমাত্র ব্যক্তি ছালাউদ্দিন। গত সাত বছর ধরে তিনি অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
ছালাউদ্দিন জানান, গত সাত বছর ধরে যেভাবে রোগী পরিবহন করেছেন এখনও একইভাবে কাজ করছেন। প্রতিদিনই রোগী নিয়ে হাসপাতাল ও হাসপাতাল থেকে রোগীর বাড়ি ছুটছেন। কে করোনা আক্রান্ত আর কে করোনা আক্রন্ত নয় সেটা জানতে চান না রোগীদের কাছে। তার কাছ রোগীর সেবাই মূল লক্ষ।
তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবে অনেক সময় করোনায় আক্রান্ত রোগী ও করোনার উপসর্গের রোগী বহন করবো না ভাবি। কিন্তু নিজের মনকে মানাতে পারি না। কারণ মানুষ যখন বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই হাসপাতালে ছুটে আসে। আর সে সময় যদি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে যাই তাহলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমার পরিবারের মত তারও তো পরিবার আছি। এ কথা ভেবে সব সময় কাজ করে যাচ্ছি।
Advertisement
ভোলা সদরের অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. নাঈম হাসান বলেন, আমি প্রতিদিনই নানান রোগী অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল ও হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাই। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ব্যবহার করি। সারাদিন কাজ করে যখন বাড়ি ফিরি। তখন বাড়ির আশপাশের লোকজন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অনেকে আমাকে দেখে পালিয়ে যায়। তাদের ধারণা আমরা রোগী পরিবহন করি বলে করোনায় আক্রান্ত। এ সময় খুব খারাপ লাগে। তারপরও মানুষের সেবায় নিয়োজিত রয়েছি। যত সমস্যাই হোক না কেন যতদিন এ পেশায় থাকবো এভাবে কাজ করে যাব।
তিনি আরও বলেন, আমার পরিবারের সদস্যরা ভয় না পেয়ে আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। সাবধানে থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের মো. রিয়াজ বলেন, আমরা অ্যাম্বুলেন্স চালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগী পরিবহন করে যাচ্ছি। কিন্তু কেউ আমাদের কোনো খবর রাখে না। এমনকি আমাদের কেউ একটি পিপিইও দিচ্ছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডাক্তার-নার্সদের মত আমরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছি। আমাদেরকে কিছু সহযোগিতার জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই।
ভোলার অ্যাম্বুলেন্স মালিক মো. হাবিবুর রহমান বাবলু বলেন, আমাদের ড্রাইভাররা করোনা পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছেন। আমরা তাদের মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যাক্সিসল কিনে দিয়েছি। বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সে ভাড়া কম হচ্ছে। কিন্তু আমরা ড্রাইভারদের ঠিক সময়ে বেতন পরিশোধ করছি।
ভোলা অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি মো. মিলন হাওলাদার বলেন, আমরা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের যতটা পারি সহযোগিতা করে যাচ্ছি। রোগী পরিবহন করার কারণে অনেক ড্রাইভার ও হেলপারকে মানুষ নানান কথা বলায় তাদের মন ভেঙে যায়। আমরা তাদের মনে সাহস জুগিয়ে আবার কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য বলি।
তিনি আরও জানান, আমি সিভিল সার্জনের কাছে জেলার সকল সরকারি ও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার এবং হেলপারদের নিরাপত্তার জন্য পিপিই চেয়েছি। এছাড়াও রোগী পরিবহন করতে গিয়ে কোনো ড্রাইভার ও হেলপার যদি করোনায় আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে বিনামূল্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বলেছি। আশা করি ভোলা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ মানবিক দিক বিবেচনা করে এসব দাবি পূরণ করবে।
ভোলার সিভিল সার্জন ডা. রতন কুমার ঢালী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ও হেলপাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগী পরিবহন করছেন। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাদের কয়েকজনকে পিপিই প্রদান করেছি। পরবর্তীতে আরও পিপিই প্রদান করা হবে। এছাড়াও তাদের যেসব দাবি রয়েছে তা পূরণ করার চেষ্টা করছি।
জুয়েল সাহা বিকাশ/আরএআর/পিআর