বিশেষ প্রতিবেদন

পতিত জমি ১১ কোটি শতক, আসছে চাষাবাদের আওতায়

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে সামনের দিনগুলোতে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় দেশের পতিত জমিতে চাষাবাদ নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। করোনাকালে খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পর ভূমি ও কৃষি মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ নিয়েছে। মন্ত্রণালয় দু’টির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

Advertisement

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বাংলাদেশেও নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এদেশে করোনায় আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। প্রতিদিনই অবস্থার অবনতি হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯৮ হাজার ৪৮৯ জন। এদের মধ্যে মারা গেছেন এক হাজার ৩০৫ জন। যদিও দীর্ঘদিন ছুটি থাকার পর সরকার সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিধি মানা সাপেক্ষে অফিস খুলে দিয়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফ্রি), জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, করোনার প্রভাবে অনেক দেশেরই অর্থনীতিতে একটা সংকট আসতে পারে। এর প্রভাব খাদ্য উৎপাদনের ওপর পড়বে। খাদ্য সংকট হবে, এমনকি দুর্ভিক্ষও হতে পারে।

যদিও এখন পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। এটা ধরে রাখতে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে পতিত জমিতে চাষাবাদ নিশ্চিত করা হলে তা উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হবে বলেও মনে করেন তারা।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, কারও এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে, ঘরের কোণায় হলেও একটা কিছু ফসল ফলান

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত বছর প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২২৬ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার শতক। এসব জমির মধ্যে বসতবাড়ি, পুকুর, স্থায়ী ফসলি জমি, অস্থায়ী ফসলি জমির পাশাপাশি পতিত জমিও রয়েছে। পতিত (স্থায়ী ও অস্থায়ী পতিত) জমি রয়েছে প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক। যা দেশের মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলেছি, তারা যেন কোনো পতিত জমি না রাখেন, সেখানে যেন চাষাবাদের ব্যবস্থা করেন। সেখানে যেভাবে সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘জমির প্রকৃতি অনুযায়ী, কোথাও ধান আবাদ, কোথাও বাগান করা হবে, কোথাও ফলের গাছ লাগানো হবে।’

Advertisement

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না বলেছেন, চাষাবাদ করতে হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় কমিশনারদের মৌখিক নির্দেশনা দেই, তাদের সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে।’

‘আমরা তাদের বলেছি, সমন্বিতভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বসে যেন তারা এ বিষয়ে প্রচারণা চালান।’

এরপর অফিস খোলার পর ডিজিটালি মিটিং করে মাঠ পর্যায়ে আবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘মানুষকে বোঝানো- পতিত জমিতে চাষ করবেন, আপনার নিজের প্রয়োজনে। জমি ফেলে না রেখে চাষ করলে আপনারা কাজে লাগবে। আপনি যদি বাইরে থাকার কারণে চাষাবাদ না করতে পারেন, তাহলে আমাদের দেশের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে বর্গা দিয়ে চাষ করতে পারেন। এভাবে পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সমবায় ভিত্তিতেও করা যেতে পারে, জাতির পিতা এ বিষয়ে তো অনেক আগেই বলে গেছেন।’

দেশে পতিত জমি রয়েছে প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক, এসব জমিতে নিশ্চিত করা হবে চাষাবাদ

মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা ডিসি (জেলা প্রশাসক), এডিসি (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা), এসি ল্যান্ডদের (সহকারী কমিশনার, ভূমি) সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। পড়ে থাকা জমির বৈশিষ্ট অনুযায়ী যেন চাষ করা হয়। সেখানে যেটা হবে, সেটারই চাষ করা হোক।’

১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে বলা হয়েছে, যদি কেউ বকেয়া খাজনা পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা না রেখে স্বেচ্ছায় বাসস্থান ত্যাগ করেন এবং নিজে বা তার পরিবারের সদস্য বা কর্মচারী বা শ্রমিক বা অংশীদার অথবা বর্গাদারের সাহায্যে একনাগাড়ে তিন বছর কাল পর্যন্ত তার জোত (আবাদি জমি) চাষবাদ করা থেকে বিরত থাকেন, তবে জোতে রায়তের (জমির মালিক) স্বত্বের (মালিকানা) পরিসমাপ্তি ঘটবে।

কোনো রায়তের ওপর কোনো ভূমির স্বত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে ন্যস্ত হয়। যিনি নিজে প্রকৃত চাষি নন এবং যিনি নিজে অথবা তার পরিবারের লোকজন, কর্মচারী বা বর্গাদারদের সহায়তায় একনাগাড়ে পাঁচ বছর চাষবাদ করতে ব্যর্থ হন বা ওইরূপ চাষাবাদ না করার কোনো কারণ না থাকে, সেক্ষেত্রেও জমির মালিকানার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে আইনে বলা হয়েছে।

ভূমি সচিব বলেন, ‘প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী দীর্ঘদিন জমি চাষ না করলে তা সরকারের অনুকূলে জেলা প্রশাসন নিয়ে নিতে পারে। তবে এটি একটা দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। এটা হলো শেষ কথা, আমরা সেখানে যেতে চাই না, আমরা জনগণের বন্ধু হতে চাই। আমরা মালিককে উদ্ধুদ্ধ করে পড়ে থাকা জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে চাই।’

‘আমরা জনপ্রতিনিধিদের এ কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য বলেছি, জুমার বয়ানে যেন এ বিষয়ে আলোচনা হয়, সেই বিষয়ে ডিসিদের বলা হয়েছে।’

মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা যদি পতিত জমি খাস করে নিই, রাষ্ট্র অনেক বড় হয়ে যাবে না। কিন্তু ব্যক্তির ক্ষতি হবে। আমরা চাই ব্যক্তি সমৃদ্ধ থাকুক, তার মধ্যে মানবিক চেতনা আসুক। নিজের দায়িত্ব সে পালনের মাধ্যমে পতিত জমিটা চাষ করে করে সে রাষ্ট্রকে, দেশের মানুষকে কিছু দিক। পতিত জমিতে যদি দুটো লাউও হয়, সেটা তার ও মানুষের কাজে লাগবে।’

আরএমএম/এইচএ/পিআর