অর্থনীতি

অদক্ষ ও স্বল্প অর্থনৈতিক জ্ঞান প্রবাসীদের বিপদাপন্ন করে তুলছে

দক্ষতার অভাব এবং স্বল্প অর্থনৈতিক জ্ঞান অভিবাসীদের বিপদাপন্ন করে তুলছে। একই কারণে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আহরণ হচ্ছে না। এমন তথ্যই উঠে এসেছে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএমের এক গবেষণা প্রতিবেদনে।

Advertisement

মঙ্গলবার (১৬ জুন) ‘বাংলাদেশে অভিবাসন, ফ্যামিলি রেমিট্যান্স, সম্পদ এবং দক্ষতার শ্রেণিবিভাগ’ বিষয়ক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইওএম। ২০১৯ সালে ১০০০ রেমিট্যান্স-নির্ভর পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপ ও মূল অংশীদারদের সাথে গুণগত আলোচনার ভিত্তিতে উঠে আসা ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদনে। আইওএম বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

জরিপে দেখা গেছে, উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের তুলনায় অধিক অর্থ দেশে পাঠান। দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে মাসিক হারে প্রায় ২৫৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত। অভিবাসীদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে রেমিট্যান্স কীভাবে বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় করা হবে। দক্ষ অভিবাসীরা পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ করেন সঞ্চয় অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স বিনিয়োগ করতে। আর অদক্ষ অভিবাসীরা তাদের রেমিট্যান্স মূলত লোন পরিশোধে খরচ করেন। উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসী কর্মীরা ভালো বেতনের চাকরিতে নিয়োগ পান এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অধিকতর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী এবং রেমিট্যান্স প্রেরকদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ (৯৮ শতাংশ)। এদের প্রায় ১২ শতাংশ অভিবাসী কর্মী একেবারেই স্কুলে যাননি এবং প্রায় ৮০ শতাংশ পড়াশোনা করেছেন মাধ্যমিক পর্যন্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অর্ধেক অংশ কাজ করছেন কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে (৪৯ শতাংশ) এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৬ শতাংশ) কাজ করছেন শ্রমিক হিসেবে, যার মধ্যে দিন মজুর এবং খণ্ডকালীন শ্রমিক আছেন। বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মীরা অন্য দেশের দক্ষ কর্মীদের তুলনায় কম অর্থ পাঠাতে পারেন বা অর্থনৈতিকভাবে কম লাভবান হন। কারণ অদক্ষ এবং স্বল্প দক্ষ কর্মীরা যে পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করেন, তা দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম।

Advertisement

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা সর্বোচ্চ (৭৬ শতাংশ)। রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারের মোট ৬৫ শতাংশ পরিচালনা করেন নারী, যারা মূলত বেকার এবং সাধারণত রেমিট্যান্সকে অ-আয় উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে খরচ করেন।

জরিপ মতে, রেমিট্যান্স মূলত স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হয় এবং সম্পদের বৈচিত্র্য আনতে বা আর্থিক স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে খুব কমই ব্যবহৃত হয়, যা রেমিট্যান্সের ওপর পরিবারের নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের স্বল্প অর্থনৈতিক জ্ঞান তাদের টেকসই উপার্জন, রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়।

গবেষণায় যে সকল সুপারিশসমূহ উঠে এসেছে তা হলো, প্রথমত, জেন্ডার-সংবেদনশীল দক্ষতা বিকাশের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে এবং পরিবারের অর্থনৈতিক জ্ঞান ও রেমিট্যান্স পরিচালনার ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে, যেন স্বল্প দক্ষ অভিবাসী কর্মী আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন এবং ঋণের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন।

তৃতীয়ত, বিপদাপন্নতা হ্রাসে এবং আর্থিক স্বাধীনতার পথে সহায়তা প্রদানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন উন্নত ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং সঞ্চয়ের আনুষ্ঠানিকীকরণ নিশ্চিত হয়। চতুর্থত, নারীদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক নীতি নিতে হবে, যেন অর্থনীতির পরিমাপ এবং টেকসই কৌশলসমূহ বিবেচনা করে সম্পদ উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

Advertisement

সর্বশেষে অভিবাসী এবং রেমিট্যান্স প্রাপকদের জেন্ডার-সংবেদনশীল অর্থনৈতিক শিক্ষা এবং পরামর্শ দেওয়ার জন্য পার্টনারশিপ গঠনের সুপারিশ করা হয় এই গবেষণায়।

আন্তর্জাতিক ফ্যামিলি রেমিট্যান্স দিবসে উপলক্ষে সকল জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃরেকত্রীকরণে সহায়তা প্রদান এবং অপবাদ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানানো হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটের ফলে হাজার হাজার অভিবাসী কর্মী বছর শেষে দেশে ফিরে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মন্দা সংক্রান্ত কারণে চাকরি ছাঁটাইয়ের ফলে শুধু রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারগুলোই নয়, প্রভাবিত হবে তাদের কমিউনিটিও।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালেই সাত লাখ অভিবাসী কর্মী দেশ ছেড়ে বিদেশে যান কর্মসংস্থানের খোঁজে। ২০১৯ সালে প্রবাসীরা বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান, যা দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৭৩ শতাংশের বেশি আসে উপসাগরীয় দেশসমূহ থেকে। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ সরাসরি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে এবং অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে।

গবেষণা ফলাফল বিষয়ে আইওএম’র বাংলাদেশ মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, ‘অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন আমাদের মন্দা-প্রভাবিত রেমিট্যান্স নির্ভর মানুষকে সহায়তায় অধিক নজর দিতে হবে। আমাদের অভিবাসী কর্মীদের দক্ষতা বিকাশকে অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য সরকারকে সহায়তা করা প্রয়োজন, যাতে অভিবাসী কর্মীরা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে পারেন। একইসাথে তাদের পরিবার, বিশেষ করে নারীদের, অর্থনৈতিক শিক্ষা প্রদানে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে রেমিট্যান্স উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত হয় এবং রেমিট্যান্স নির্ভর পরিবারগুলোর স্থিতিস্থাপকতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তৈরি হয়।’

এমইউএইচ/এইচএ/এমএস