প্রথম দুবার টার্গেট করেও পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। তৃতীয়বার সফল হতে দীর্ঘ সময় নিয়ে গাজীপুরের ইনক্রেডিবল ফ্যাশন্স লিমিটেড নামে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতনের টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে ডাকাত দল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মী সেজে গার্মেন্টসে কাজও করেন ডাকাত দলের এক সদস্য। সর্বশেষ গত ৭ জুন মাত্র ৫-১০ মিনিটে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে ৮০ লাখ ২২ হাজার টাকা লুটে নেয় ডাকাত দলটি।
Advertisement
গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সুরিচালা এলাকায় ওই কারখানার মাইক্রোবাস থেকে এই লুটে নেয়ার ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় ৭ জুন রাতেই পোশাক কারখানাটির জেনারেল ম্যানেজার (প্রডাকশন) খোরশেদ আলম কালিয়াকৈর থানায় মামলা করেন।
এরপর শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারীসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেফতাররা হলেন- রিয়াজ (৩৬), সাগর মাহমুদ (৪০), জলিল (৪০), ইসমাইল হোসেন মামুন (৪৫) ও মনোরঞ্জন মন্ডল বাবু (৪১)।
Advertisement
তাদের কাছ থেকে নগদ ৩০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, ১ হাজার ১০০ ইউএস ডলার, ১টি প্রিমিও ব্র্যান্ডের প্রাইভেটকার, ৩টি মোটরসাইকেল, ১টি বিদেশি রিভলবার, ১টি বিদেশি পিস্তল, ২১ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২টি ম্যাগজিন, ৩টি পাসপোর্ট এবং ৩৮টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
র্যাব বলছে, গ্রেফতাররা সবাই পেশাদার অপরাধী। সবারই বিরুদ্ধে অপরাধ সংশ্লিষ্ট একাধিক মামলা রয়েছে।
রোববার (১৪ জুন) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি জানান, প্রায় ৪-৫ মাস আগে চক্রটির মূল হোতা জলিল গার্মেন্টসের টাকা ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। এ জন্য তথ্য সংগ্রহে নিয়োগ দেন ইসমাইল হোসেন এবং মনোরঞ্জন মন্ডলকে।
Advertisement
তারা অনেকগুল গার্মেন্টসের তথ্য দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ শেষে ইনক্রেডিবল গার্মেন্টসের টাকা লুটের জন্য টার্গেট নির্ধারণে পরামর্শ দেন।
তাদের পর্যবেক্ষণ, ওই ইনক্রেডিবল গার্মেন্টসের শ্রমিকদের বেতন ক্যাশে প্রদান করা হয় এবং ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহের সময় কোনো অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী থাকে না।
সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, 'পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোরঞ্জন ওই গার্মেন্টসে সাব-কন্টাক্টের কর্মী হিসেবে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আসা-যাওয়া শুরু করেন। এর আড়ালে তিনি গার্মেন্টসের অন্যান্য কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী, পার্শ্ববর্তী দোকান ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে কৌশলে তথ্য সংগ্রহ করেন। তার তথ্যের ভিত্তিতেই ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। তবে তাদের এপ্রিলে প্রথম ও মে'তে দ্বিতীয় দফায় ডাকাতির পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কারণ, এপ্রিলের বেতন দেয়া হয়েছিল মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এবং মে মাসের বেতনের টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল পুলিশ স্কটের (টাকা বহনে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ স্কট সরবরাহ করা হয়ে থাকে) মাধ্যমে।'
'অবশেষে জুনের বেতন সংগ্রহের সময় পুলিশ স্কট থাকবে না বলে নিশ্চিত হওয়ার পর ৭ জুন ডাকাতির দিন নির্ধারণ করে তারা। ঘটনার প্রায় ১২-১৫ দিন আগে ইসমাইল, জলিল এবং মনোরঞ্জন মাঠপর্যায়ে রেকি (লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ও আক্রমণপূর্ব পর্যবেক্ষণ) করে ডাকাতির জন্য সুবিধাজনক বিভিন্ন স্থান নির্বাচন করেন।'
ঘটনার বিবরণে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আরও বলেন, 'পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন প্রথমে তিনটি মোটরসাইকেলযোগে ছয়জন একটি সুবিধাজনক স্থানে মিলিত হয়। পেছনের আরোহীদের সবাই অস্ত্র বহন করেছিল। অন্যদিকে ছিনতাইয়ের টাকা বহনের জন্য একটি প্রাইভেটকার জামগড়া নামক স্থানে অপেক্ষা করছিল। মনোরঞ্জন গার্মেন্টস এলাকা থেকে ডাকাত দলটিকে প্রতি মূহুর্তের তথ্য সরবরাহ করছিল।'
'বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোবাইলে মূলহোতা জলিলকে টাকা উত্তোলনের জন্য গার্মেন্টসের লোকজন মাইক্রোবাসে করে ব্যাংকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে বলে জানায় মনোরঞ্জন। তথ্যের ভিত্তিতে সফিপুরে অপেক্ষমাণ তিনটি মোটরসাইকেল নিরাপদ দূরে থেকে মাইক্রোবাসটি অনুসরণ করতে থাকে।'
'টাকা উত্তোলনের পর ফেরার পথে খাড়াজোড়া এলাকায় দুটি মোটরসাইকেল মাইক্রোবাসের সামনে গিয়ে কৌশলে ব্যারিকেড দেয়। এরপর লোহার হ্যামার দিয়ে মাইক্রোবাসের গ্লাস ভেঙে ফেলে এবং অতর্কিতভাবে মাইক্রোবাসের সামনের অংশে গুলি ছোড়া শুরু করে ডাকাতরা। এতে একটি গুলিতে ওই মাইক্রোবাসে থাকা গার্মেন্টসের সহকারী মার্চেন্ডাইজার রাজীব মজুমদার গুরুতর জখম হন।'
'সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জোরপূর্বক টাকা ছিনিয়ে নিয়ে মাত্র ৫-১০ মিনিটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ডাকাত দল। ঘটনাস্থলে এলোপাতাড়ি গুলির ফলে দলের মূল হোতা জলিল নিজ হাতেও গুলিবিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা মোটরসাইকেলযোগে জামগড়া কাশিমপুর রোডে অপেক্ষমাণ প্রাইভেটকারের কাছে পৌঁছে। গুলিবিদ্ধ জলিল এবং লুটকৃত টাকা নিয়ে সাগর ও রিয়াজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।'
লে. কর্নেল সারওয়ার আরও বলেন, 'তারা প্রথমে সবাই সাগরের খিলগাঁওয়ের বাসায় যায়। সেখান থেকে জলিলকে মালিবাগের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পথিমধ্যে টাকাগুলো ভাগ করে নেয়। কাজের ধরন অনুযায়ী ৮ লাখ ২০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা এবং অস্ত্র বহন ও গুলি এবং প্রাইভেটকার প্রদান করার জন্য আলাদা আলাদাভাবে টাকা দেয়া হয়।'
তিনি জানান, মূলত ৮-১০ জনের একটি সিন্ডিকেটে এই ডাকাতির ঘটনাটি ঘটিয়েছে। দলের মূলহোতা জলিলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থাকায় গ্রেফতার এড়াতে তিনি ২০১৬ সালে প্রবাসে পাড়ি জমান। ৭-৮ মাস আগে দেশে ফিরে আবারও ডাকাতির পরিকল্পনা করেন জলিল।
চক্রটি ডাকাতি, ছিনতাই ছাড়াও মাদক, চাঁদাবাজি ও পতিতাবৃত্তির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।
জেইউ/জেডএ/এমএস