মতামত

নাসিম ভাইকে যেমন দেখেছি

করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন যাবত গ্রামের বাড়িতে বাসাবন্দি অবস্থায় আছি। সবার প্রিয় নাসিম ভাই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মনের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করতো, এমনকি রাতের ঘুমটিও ঠিকমতো হয়নি। তাই প্রতিদিন তাঁর পরিবারের সদস্য বা কর্মচারীদের কাছে সকাল-বিকাল অন্তত দুইবার ফোন করে খবর নিতাম।

Advertisement

প্রতিদিনের মতো আজও বই পড়তে ব্যালকনিতে বসেছিলাম। একজন সাংবাদিক ভাই ফোন করে জানালেন আমাদের নাসিম ভাই আর নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওনার পরিবারের সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে ফোনে নিশ্চিত হলাম এবং দৌড়ে ঘরে এসে টিভি স্ক্রলে ভেসে উঠতে দেখলাম মোহাম্মদ নাসিম আর নেই। কখন যে চোখের পানি গড়িয়ে পড়েছে তা নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি। ঠিক তখনই বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝড়ছে। যেন প্রকৃতিও তাঁর প্রয়াণে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করছে, যেন মানুষ ও প্রকৃতি দুঃখ কষ্টে একাকার হয়ে গেছে!

মোহাম্মদ নাসিম শুধু শহীদ এম মনসুর আলী সাহেবের সুযোগ্য সন্তানই ছিলেন না, এদেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদদের কাতারে ওঠে এসেছিলেন এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। অর্জন করেছিলেন সাধারণ মানুষ, নেতাকর্মীদের ভালোবাসা, যা তাঁকে অমর করে রাখবে। নেতার সাথে আমার প্রথম সরাসরি কথা হয় ২০০২ সালে যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ও বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতাসীন। সে সময় একটি সভায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার পর আমাকে হুমকি দেয়া হয়। তখন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও সূর্য ভাই আমাকে ওনার বাসায় নিয়ে যান। নাসিম ভাই আমার বিষয়টি শুনে হাসতে হাসতে বললেন, ‘গরম বক্তব্য দেয়ার সময় মনে ছিল না? আর রাজনীতি করতে গেলে অবশ্যই মামলা-হামলা এগুলো মেনে নিয়েই করতে হয়। আর ও তো আইনজীবী, ও তো আমাদেরও দেখে রাখবে।’ তারপর অবশ্য এটাও বললেন, যদি কোনো সমস্যা হয় তখন অবশ্যই উনি দেখবেন। প্রথমদিনই আমার মতো ক্ষুদ্র কর্মীর বিপদে পাশে এসে দাঁড়ানো, আশা-ভরসা দেওয়া এবং একজন নবীন আইনজীবীর প্রতি তার মূল্যায়ন দেখে নেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল। আমি তাঁর অনুরক্ত হলাম।

এরপর ২০০২ সালে আমি পূর্ণিমা রাণী ধর্ষণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে ৫০ এর অধিক আইনজীবী সিরাজগঞ্জ জেলা আদালতে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিলে তিনি আমাকে বিষয়টি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেন। অতঃপর ২০০৩ সালে জেলহত্যা মামলার আইনজীবীরা নিজেদের প্রত্যাহার করেন এবং হাইকোর্টে রিট হলে তিনি এ মামলায় আমাকে সম্পৃক্ত করেন। ২০০৪ সালে বাচ্চু হত্যা মামলায় নেতাকে রাজনৈতিকভাবে জড়ানো হলে তা হাইকোর্টে স্থগিত করতে সক্ষম হই। এছাড়াও ওনার পারিবারিক বিষয়-সম্পত্তির মোকাদ্দমা, সর্বোপরি ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় মনোনয়নপত্রে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা মোকাদ্দমার কাগজপত্রের আইনগত দিক দেখার দায়িত্বও তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর আস্থা অর্জন ও অন্যতম ব্যক্তিগত আইনজীবী হয়ে ওঠা।

Advertisement

এদিকে ২০০৩ সালে উল্লাপাড়া থানা কমিটি যখন হয় তখন নেতা আমাকে সদস্য করার সময় বলেছিলেন, ‘আমি আজকে আছি, রেখে দিলাম। পরে একটা সময় দেখবে তোমার যোগ্যতা থাকার পরও রাখবে না।’

নেতার সেই বাস্তববাদী কথাটা আজকের এ বাস্তবতায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। প্রিয় নেতা আমাকে ‘বশর’ নামে ডাকতেন। আমি ভাবতাম হয়তো আমার শোনার ভুল। কিন্তু তিনি আমার কাছে এক মক্কেলের কাছে ওনার অফিসিয়াল প্যাডে একটি চিঠি লিখেন, যার শুরু করেছিলেন ‘প্রিয় বশর’ দিয়ে... । যদিও পরে তিনি আমাকে ব্যারিস্টার বলেই বেশি সম্বোধন করতেন। এটা ছিল কর্মীর প্রতি নেতার স্নেহমাখা ভালোবাসার ডাক।

২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাসহ নেতাকর্মীদের একই স্থানে হত্যার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের হামলার সভাস্থলের কিছু দূরেই আমি ছিলাম। যখনই শুনলাম নাসিম ভাই আহত হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে আমি উনার ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে দেখি নেতা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েও তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার সাথে মতিন খসরু ছিল। একটু দেখোতো তাদের কী অবস্থা।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম আর জানলাম তিনিও আহত হয়েছেন। এই বিপদে বিশেষত নিজে আহত অবস্থায় থেকেও অন্যের খোঁজ নেয়া কেবল একজন আত্মত্যাগী নেতার পক্ষেই সম্ভব।

২০১৪ সালে যখন বার এট ল করে ফিরে আসি তখন বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতায় সারাদেশ দাউ দাউ করে জ্বলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি পুনরায় মন্ত্রী হলেন আর স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারপরও আমি যোগাযোগ রাখতাম। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালীন মানুষের কাছাকাছি যাওয়া খুবই কঠিন। এটাই চরম বাস্তবতা। তারপরও তিনি কোনোদিনই এটা আমাকে বুঝতে দেননি। এভাবেই আমার প্রতি নেতার পুরোনো আস্থা ফিরে আসে এবং তিনি তাঁর নিজের বিষয়-সম্পত্তির মামলাসহ যেকোনো আইনগত বিষয়ে উনি আমাকে ফোন দিতেন ও আলোচনা করতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, ক্ষমতার মধ্যে থেকেও পুরোনো দুঃসময়ের কর্মীর প্রতি তাঁর নিখাঁদ ভালোবাসা এবং একজন আইনজীবীর মূল্যায়ন।

Advertisement

নেতার সাথে আমার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক থাকলেও কোনোদিন তদবির নামক অযাচিত বিরক্ত না করায় প্রায়ই আমার প্রশংসা করতেন। তিনি কর্মীদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যা করতেন। আমার বিভিন্ন বিষয়ের প্রেস ব্রিফিং ও টকশো’র অনুষ্ঠান দেখতেন এবং যখনই নেতার সাথে দেখা হতো বা ফোনে কথা হলে প্রথমেই বলতে, ‘তোমাকে টিভিতে দেখলে আমার মনটা ভরে যায়’। মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলেই এভাবে উৎসাহ দেয়া সম্ভব। প্রিয় নেতার এ দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে সর্বদাই অনুপ্রাণিত করেছে।

২০১৬ ও ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি অভ্যর্থনা উপকমিটির আহ্বায়ক হন ও আমাকে উনি শুধু সদস্যই করলেন না ২০১৯ ‘সালে কেন্দ্রীয় আইনজীবীদের টিমের প্রধান হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেন। যেখানে অন্যান্য টিমের প্রধানরা ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন বিভাগের সম্পাদক। এটি ছিল অভাবনীয়। নিজের একজন সাধারণ কর্মীকে মানুষের সামনে নিয়ে আসা, তাকে স্থান করে দেয়া ও সম্মান দেয়া এটা তাঁর কাছেই শিখতে হবে। আমি বিশেষভাবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসে ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ যিনি সম্মেলনের কাজে আমাকে সবধরনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ও সহযোগিতা করেছেন। নাসিম ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা আইনজীবীরা সর্বোচ্চ সংখ্যক আমন্ত্রণপত্র নিতে সক্ষম হই। তিনি আইনজীবীদের সম্মান করতেন। সম্মানিত মানুষকে সম্মান দিতেন, মূল্যায়ন করতেন।

২০১৯ সালের মন্ত্রী না হওয়া প্রসঙ্গে নেতা বললেন যে, ‘আমি মন্ত্রী আছি আমার এলাকার মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে মন্ত্রী দেখে যে আমি আবার মন্ত্রী হবো। তো এলাকার মানুষগুলো কষ্ট পাবে বা মনে করবে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এতটুকুই আমার কষ্ট। আমার নিজের জন্য কোনো কষ্ট নেই। কারণ রাজনীতি করাটাই আমার মূল লক্ষ্য। তবে মন্ত্রী না হয়ে একদিকে ভালোই হয়েছে। মন্ত্রী থাকাকালীন অনেক ব্যস্ততা থাকে। আমার এলাকার মানুষ, দেশের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মীরা আসেন কিন্তু অনেক সময় দেখা করতে পারেন না। যেহেতু এখন কোনো প্রটোকল থাকবে না, আমার ব্যস্ততাও কমে যাবে। আমি আমার এলাকায় যাব, সাধারণ মানুষকে সময় দেব।’ বিষয়টিকে তিনি এভাবেই দেখেছেন।

ক্ষমতা ওনার কাছে বড় ছিল না। মানুষের সাথে মেশা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও সহযোগিতা করার যে মানসিকতা তা আমি নেতার মধ্যে দেখেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘদিনের জমানো অব্যবস্থাপনার জন্য যারা সমালোচনা করেন, তাদের মনে রাখা উচিত তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে দক্ষিণ অঞ্চলের চরমপন্থীদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে সেখানে মানুষ যে রাত্রে শান্তিতে ঘুমান তা মোহাম্মদ নাসিমের অবদান!

আমার একটি কলাম ‘মেধাদীপ্ত উচ্চশিক্ষিত জাতীয় চারনেতা’ সংবাদপত্রে পড়ে অনেক প্রশংসা করলেন। তখন অনেক দিন মনের মধ্যে লুকানো প্রসঙ্গে তুললাম, ১৯৭৫ সালে শহীদ এম মনসুর আলী সাহেবকে গুলি করার পর উনি যখন পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন খুনিরা ফিরে এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওনার মৃত্যু নিশ্চিত করে। লোমহর্ষক হত্যার বিষয়ে তার উপলব্ধি উনি প্রকাশ করলেন, ‘সাধারণ মানুষের মতো তো কষ্ট হয়ই। তার ওপর নিজের পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ড। সে সময় তিনি পাবনায় বাকশালের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিজের পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মুখটাও দেখতে পারেননি। কারণ তিনি দেখতে গেলে তাঁকেও গ্রেফতার করা হতো ও হত্যা করা হতো।’ ঠিক আজও আমার এ সময়ে মনে হয় তার এত কাছে থেকেও, তার জন্য এত ভালোবাসা, অতলশ্রদ্ধা থাকার পরও বৈশ্বিক মহামারির কারণে তাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগটা আমার হলো না।

চলমান রাজনীতিতে বিশেষ করে ক্ষমতার সময় অনেকের আগমন নিয়তির নিয়মেই ঘটবে, হয়তোবা পদ দিয়ে যে কাউকে পরিচিত করা যাবে, তবে নেতা বানানো যাবে না। আর মোহাম্মদ নাসিমের মতো বিশ্বস্ত, পরীক্ষিত, অভিজ্ঞ ও জনগণের নেতা আমরা পাব কিনা তা অত্যন্ত অনিশ্চিত। তার মৃত্যু সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতার প্রয়াণ! শুধু সিরাজগঞ্জ নয় সমগ্র উত্তরবঙ্গ হলো অভিভাবকহীন, আর দুর্দিনে পুরো দল তার অভাব বারবার অনুভব করবে।

এইচআর/বিএ