সালমা সিদ্দিকী
Advertisement
জোড় সাল নিয়ে কেন জানি না আমার ভেতর একধরনের পক্ষপাতিত্ব ছিল। যেকোন শুভকাজের জন্য জোড় সালকেই বেছে নিতে চাইতাম। অথচ ডাবল জোড় সাল, বিশ বিশের বিষময়তা সেই পক্ষপাতকে সমূলে উৎপাটন করেছে। এই ‘অদ্ভুত আঁধার’ সময় আমাকে শিখিয়েছে বেঁচে থাকার লড়াটাই মুখ্য এখন। কোভিড-১৯ নামের যে অদৃশ্য প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রলয়নৃত্যে চারদিক টালমাটাল, ব্যক্তিগতভাবে মোকাবেলার পর আমি এর নাম দিয়েছি ‘লম্পট’ ভাইরাস। ঘনঘন স্বভাব, বৈশিষ্ট্য, আচরণ বদলে ফেলা তো চরিত্রহীনেরই কাজ। তাই এরকম নামকরণ। যাই হোক, আমার লেখা থেকে যদি কারো সামান্যতম উপকারও হয়, দুঃসময়ে কিঞ্চিত মনোবল বাড়াতে সহযোগিতা করে তবেই চেষ্টা স্বার্থক। আর সে কারণেই জাগো নিউজের আমন্ত্রণে এ অভিজ্ঞতা শেয়ার করার প্রয়াস।
আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের সাথে বর্তমান সময়ের বিশেষ মিল দেখতে পাই আমি। প্লেগ আসার কারণে শহরের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো, মানুষকে আলাদা থাকতে হলো, প্রিয় স্পর্শ নিষিদ্ধ হলো কিংবা প্লেগ আসার পর কর্তৃপক্ষের সেসব অস্বীকার করার অপচেষ্টা, অদৃষ্টের কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ-এসব যেন বর্তমানের আয়নায় সেই সময়েরই প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসের স্পর্শ নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়টি আমার অভিজ্ঞতায় কীভাবে রিলেট করলাম, সে কথা একটু পরে বলছি; এখন বরং সংক্রমিত হওয়া এবং সুস্থ হওয়ার ব্যাপারটা বলে নেই।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, আমাদের দেশে ৮ মার্চ প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয়। আর সার্বিক বিবেচনায় সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে ২৬ মার্চ থেকে। যদিও অন্যান্য জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংকগুলো এ ছুটির আওতামুক্ত ছিল। তাই আমার স্বামী মো. শফিকুল ইসলাম (এভিপি অ্যান্ড অপারেশন ম্যানেজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বসুন্ধরা ব্রাঞ্চ) যথারীতি অফিস করছিলেন। সাধ্যমতো সতর্কতা মেনেই চলছিলেন। তবু মে মাসের ১০-১১ তারিখে তিনি হালকা জ্বর, খাবারে অরুচি, মাথার তালু, কানের পেছনে ব্যথা অনুভব করার কথা জানান। জ্বর ৯৯-১০০ কিন্তু ব্যথা অনেক বেশি। তিন দিন দেখার পর কোভিড টেস্টের স্যাম্পল দিয়ে আসি। তবে দুঃখজনকভাবে সে টেস্টের রিপোর্ট মিসিং অর্থাৎ কোন রিপোর্টই আসেনি। এর চারদিন পর আবার স্যাম্পল দেই, আটচল্লিশ ঘন্টা পর রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। কিন্তু জ্বর ১০১, ব্যথা বাড়ছে। তখন ডাক্তারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে পাঁচ দিন একটি করে এজিথ ৫০০মিগ্রা খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। ওষুধ চলা অবস্থায়ই বমি, লুজ মোশন হয়ে ডায়রিয়ার মতো দেখা দেয়। এরপর জ্বর ১০৩, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওই অবস্থায় কোথায় নিয়ে যাব? খুব অসহায় লাগছিল।
Advertisement
পরে বক্ষব্যাধি ও ইন্টারনাল মেডিসিনের প্রফেসর ডাক্তার তারেক আলমের কাছে নিয়ে যাই। তিনি তাৎক্ষণিক এক্স-রে করে ফুসফুসের অবস্থা দেখে সংক্রমণ শনাক্ত করেন। আগে থেকেই অ্যাজমার সমস্যা থাকায় এবং ফুসফুসের ইনফেকশন দেখে তিনি হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেন। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির আগে দু’দিন পর্যবেক্ষণের অনুমতি নিয়ে নেবুলাইজার মেশিন, ওষুধ ইত্যাদি কিনে বাসায় নিয়ে আসি। হোয়াটসআপে সার্বক্ষণিক স্যারকে রোগীর আপডেট জানিয়ে কানেক্টেড থেকেছি।স্যার আন্তরিকভাবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সাহস দিয়েছেন। তার প্রেসক্রিপশন ছিল এরকম:Cap. Doxy A 100 mg 0+0+1 10 days Tab. Ivera 6 mg 2 tab stat. then 1tab after 12 hour Tab.Omidon 10mg 1+1+1 10 daysCap.Pantonix 20mg 1+0+1 10 daysTab.Rivarox 2.5 mg 0+0+1 14 daysTab.FilFresh 3mg 1+0+1 14 days Tab.Cortan 1+0+1 7daysTab. Levoxin 0+0+1 7daysনেবুলাইজারের জন্য-windel plus- 4 times daily Budicort- 3 times daily
ওষুধ শুরুর দু’দিন পরই জ্বর নেমে যায়। ক্রমে অন্যান্য উপসর্গও চলে যায়। কিন্তু শ্বাসকষ্ট পুরোপুরি যাচ্ছিল না। ইতোমধ্যে করোনা নেগেটিভ চলে আসে। কিন্তু অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট থেকেই যায়। ডাক্তার আবার এক্স-রে করতে বলেন। হোয়াটসআপে রিপোর্ট পাঠালে, তা দেখে- Tab. Pedixa 8mg 1+0+1 7 days এবং Bexitrol F maxhaler 50/500 One inhalation 2 times daily প্রেসক্রাইব করেন। সাথে ফুসফুসের কিছু ব্যায়ামও করতে বলেন। ওষুধ চলেছে। সাথে মসলাপাতি দিয়ে গরম পানির ভাপ, গরগরা ইত্যাদি। করোনা নেগেটিভ হয়ে আইসোলেশন শেষ হওয়ায় পুনরায় অফিসে যাওয়া শুরু হয়েছে। আমি বা পরিবারের বাকিদের টেস্টও নেগেটিভ, আলহামদুলিল্লাহ।
‘দ্য প্লেগ’র স্পর্শ নিষিদ্ধের সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারার বিষয়টি খোলাসা করি। শফিক কোভিড পজিটিভ নিশ্চিত হবার পর ভয় না পেয়ে ঠান্ডা মাথায় সতর্কতার সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছি। সবাইকে জানিয়ে হুলস্থুল না করে শুধু নিকট আত্মীয়-স্বজন আর জরুরি মুহূর্তে সাহায্য করতে পারবেন, এমন মানুষদের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। টেস্টের স্যাম্পল দেওয়ার সময় থেকেই ওকে আলাদা রুমে রেখেছি। যেহেতু আমি নার্সিং করছিলাম। তাই একমাত্র ছেলে এবং বাসার কাজে সহায়তাকারী মেয়েটার থেকে আমিও দূরত্বে থাকতাম। প্রিয়জনদের লতার মত জড়িয়ে থাকা স্বভাব আমার। রাতে-দিনে সময় পেলেই ছেলের মাথায়, গায়ে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নিয়ে প্রাণ জুড়াই। সেই আমি দিনের পর দিন স্পর্শহীন থেকে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নরম কাপড়ের খেলনা কুমিরের লম্বা লেজ দিয়ে আমার গা, মাথা ছুঁয়ে ছেলে যখন বলছিল, ‘মা তোমাকে ছুঁতে পারি না। তাই এভাবে ছুঁই।’ এ কথা শুনে মনে হচ্ছিল লাফ দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করেছি। প্রিয়স্পর্শহীন থাকার নিষেধাজ্ঞা বড় কঠিন! এখানে বলে রাখি, প্রতিবেশীরা নিয়মিত ফোনে খোঁজ রেখেছে, প্রয়োজনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ঘরের সামনে রেখে যাওয়া প্রতিবেশীর খাবার খেয়েই আমার ছেলের ঈদের দিন কেটেছে। আর পুরো সময়ে দরকারি জিনিসপত্র, ওষুধ-এসবের প্রয়োজন মিটিয়েছে আমাদের ড্রাইভার ফরহাদ। ফোনে বলার সাথে সাথেই ও সব কিনে এনে দরজার সামনে দিয়ে যেত। বাসার মেয়েটা, আয়শা, ও রান্না-বান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ সামলে আমাদের ছেলের খেয়াল রেখেছে। সবার সহযোগিতায় অসুস্থতা ছাড়া অন্য কোনো প্রতিকূলতাই মোকাবেলা করতে হয়নি আমাদের বরং মনোবল শক্ত রাখতে সহায়ক হয়েছিল।
পরিশেষে বলি, নাজিম হিকমত তার উপন্যাস ‘লাইফ’স গুড’এ জেল, জুলুম, নির্বাসন সহ্যকারী চরিত্র ইসমাইলের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদার’। মানুষের চরিত্রের এই আশাবাদী দিকটি আসলে প্রবলভাবে সত্য। এই ইতিবাচক মনোভাবই তাকে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। তাই এ করোনাকালের কঠিন বাস্তবতা থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা মানুষকে পরিবর্তিত পৃথিবীতে নতুনভাবে বাঁচতে শেখাবে। সবার জন্য শুভ কামনা।
Advertisement
লেখক: শিক্ষক ও গল্পকার।
এসইউ/এএ/পিআর