নতুন অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা উচ্চাভিলাসী আখ্যা দিয়ে বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)।
Advertisement
একই সঙ্গে মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠতে যে রূপরেখা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে তা যথেষ্ট নয় বলেও অভিমত দিয়েছে ব্যবসায়ীদের এ সংগঠন।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর শনিবার (১৩ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় এ অভিমত দেয়া হয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরীর (পারভেজ) নামে পাঠানো প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, বাজেটে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে তাও অনেক উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয়।এটা আরও বাস্তবভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন।
Advertisement
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার সমালোচনা করে বিসিআই জানিয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রথা অব্যাহত রয়েছে যা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ, কালো টাকা উপার্জন এবং এর ব্যবহার উভয়ই অন্যায় এবং অবৈধ। এতে করে বৈধ অর্থ উপার্জনকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন।
বিসিআই সভাপতি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে করোনা মোকাবিলার দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে সে জন্য বিসিআই সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানায়। বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য নিরাপত্তা খাতসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রণোদনা সংশ্লিষ্ট খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
'তবে বিসিআই মনে করে করোনা পরিস্থিতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে রূপরেখা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। আরও সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন ছিল।’
ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর সীমা কমানোর বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটে, ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে, সর্বনিম্ন কর পাঁচ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ কর সীমা ২৫ শতাংশ করায় অর্থমন্ত্রীকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি, যা বিসিআইয়ের বাজেট প্রস্তাবের প্রতিফলন।
Advertisement
ব্যাংক থেকে সরকারের যে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাজেট ঘাটতি এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, এ ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণের কথা বলেছে। সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে এ পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বাজেটের ১১.২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এ মুহূর্তে অতিব জরুরি নয়। এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতি সচল করে এমন সব প্রণোদনা প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত হলেই বেশি জনকল্যাণমুখী হতো- বলে অভিমত দিয়েছে বিসিআই।
বিসিআই সভাপতি বলেন, করোনা মোকাবিলায় বাজেটের দিক নির্দেশনা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী হওয়া উচিৎ, যা প্রস্তাবিত বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি। শুধুমাত্র রফতানির ওপর নির্ভর না করে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্পে গুরুত্বারোপ করতে হবে। সরকারের যে প্রণোদনা প্যাকেজ আছে অন্তত সেটা যথাযথভাবে বিতরণ করতে হবে। কারণ বিতরণ ছয় মাস পরে করলে কোনো লাভ হবে না।
তিনি আরও বলেন, প্রবৃদ্ধি গত এক দশকে উৎসাহব্যাঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চাপে ছিল বাংলাদেশ। করোনার কারণেও সে চাপ প্রবলতর হচ্ছে। আবার বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটির সংক্রমণের কারণে বিশাল সংখ্যক প্রবাসীর চাকরি অনিশ্চয়তার মুখে। তাই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে বিদ্যমান কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতে প্রবাসী শ্রমিক এবং বেকার তরুণদের নতুন উদ্যোগ নিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে ২০০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তাদের ঋণ দেয়া হবে তা উল্লেখ নেই।ফলে অন্যান্য বছরের মতো সুযোগ সন্ধানীরাই এ ঋণ পাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে এ ব্যবসায়ী সংগঠনটির-
>> করপোরেট কর কমানোর কারণে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কিছুটা লাভবান হবে নিঃসন্দেহে। তবে করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি টিকে থাকার জন্য শিল্প ক্ষেত্রে করপোরেট করের হার হ্রাস করার অনুরোধ করছি।
>> ভ্যাট রিটার্ন পদ্ধতি সম্পূর্ণ অনলাইন করা, রিফান্ড পদ্ধতি সহজীকরণ এবং মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ধারা অনুযায়ী ভ্যাট, শুল্ক ও অগ্রীম কর দুই মাসের মধ্যে রিফান্ড করা।
>> দেশিয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম করের পরিমাণ ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ ও অগ্রিম কর সমন্বয়ের জন্য দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদে সমন্বয়ের সুযোগ দেয়ার হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। বিসিআই কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর প্রত্যাহ্যানেন দাবি করছে।
>> করোনা কারণে অনেকে এখন শহর থেকে গ্রামে মাইগ্রেট করেছে। গ্রামীণ বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন বেশি প্রয়োজন সেদিকে নজর দিয়ে কৃষি ও কুটির শিল্প নির্ভর গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় করার লক্ষ্যে বিশেষ স্কিম নেয়া যেতে পারে। আর্থিক প্রণোদনাসহ করোনা স্বাস্থ্যঝুঁকি সময় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রণোদনা অনেক বেশি গ্রামীণ অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চালন করবে।
>> করোনার প্রভাবে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রনোদনার ব্যবস্থা রাখা।
>> বর্তমান বাজেটে করোনা মোকাবিলায় থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ ব্যয় ন্যায্যভিত্তিক ও বিচক্ষণতার সহিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় সেক্টরকে সম্পৃক্ত করে একটি অভিন্ন নীতিমালা এনে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের কাছে সহজলভ্য করার বিষয় মাথায় রেখেই এ খাতে বরাদ্দ সুচারুরূপে ব্যয় করতে হবে।
>> শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেটের ১৫.১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে দক্ষকর্মী বাহিনী গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে বৃহৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কল কারখানার কর্মীদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। বাজেটে অর্থ ব্যয় কালে এ বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা থাকা প্রয়োজন।
>> সুষম আঞ্চলিক উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক না করে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত ও অনুন্নত অঞ্চলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন উৎসাহিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
>> সম্ভাবনাময় শিল্প, যেমন কৃষি, প্রক্রিয়াজাত শিল্প, হালকা প্রকৌশল, ব্লু- ইকনোমিসহ আরও অনেক। এ সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোর উন্নয়নে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর দরকার হবে। আর এক্ষেত্রে শিক্ষার বড় ভূমিকা আছে। যার মাধ্যমে পেশাদার ও কারিগরি মানুষের উন্নয়ন করা যাবে। এ জন্য মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় এখন অবশ্য প্রয়োজনীয়।
>> এসএমই উদ্যোক্তাদের ইউটিলিটি সেবাগুলোর ওপর ভ্যাট মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকা কিছুটা সহজ হবে। পাশাপাশি বিসিক এবং ইপিজেডে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভাড়াও মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করা।
>> স্থানীয় পর্যায়ে লোকাল এলসির মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে উৎসে কর ২ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে, অথচ পূর্বে কোনো উৎসে কর ছিল না। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। তাই এটি ২ শতাংশ না করে ১ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা।
>> রফতানিমুখী শিল্পের রফতানি মূল্যের ওপর উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। সকল রফতানিমুখী শিল্পের জন্য এ কর দশমিক ২৫ শতাংশ এবং করপোরেট কর ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা।
>> ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ও বৃহৎ শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সহায়তা প্যাকেজসহ সরকরার ঘোষিত সব প্রণোদনা প্যাকেজ বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এমএএস/এএইচ/এমকেএইচ