কামরুজ্জামান বাবু
Advertisement
দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে তার একক আধিপত্য বিস্তার চলছে ঢাকাই সিনেমায়। সেই তিনি এখন ঘোষণা দিলেন অর্ধেকেরও কম পারিশ্রমিক নিয়ে সিনেমায় অভিনয় করবেন! খুব ভালো কথা। কিন্তু এই যে অসময়, এখন সাহস নিয়ে সিনেমাটা বানাবেন কে? আর সিনেমা তৈরি হলে, সেটি দেখানো হবে কোথায়? সিনেমা হলে? হল কি সহসা খুলবে? যে হলগুলো বন্ধ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো তো চিরতরেই বন্ধ হয়ে গেছে।
সর্বশেষ তথ্য হলো, টিকে থাকা ১৬৫টি হলের মধ্যে একশটিই আর খোলার সম্ভাবনা নেই। তাহলে এই ৬০-৬৫টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করে কি প্রযোজকের লগ্নিকৃত টাকা উঠে আসবে? ক্যালকুলেটরে সেই হিসাব চলতে থাকুক।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এই করোনাকালে আমি কেন হঠাৎ সিনেমা নিয়ে আলোচনাটা শুরু করলাম। শুরুটা আমি করিনি। করেছেন ঢাকার সিনেমার সবচেয়ে বড় পোস্টার বয় শাকিব খান। এরই মধ্যে অনেকগুলা রেকর্ড তিনি করেছেন।
Advertisement
বাংলাদেশে সর্বাধিক পারিশ্রমিক নিয়ে ছবিতে অভিনয় করেছেন। বলা যায়, নায়কদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। যখন দেশে ৭০০ বা তার বেশি প্রেক্ষাগৃহ ছিল, তখন সবগুলোতেই শাকিব খান অভিনীত ছবি চলেছে। আর এই সময়েই তার একক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছে!
আমাদের সিনেমার নায়ক চলতি বছরটা ভালোভাবে শুরু করতে পারেননি। ২০২০ সালে ‘পাসওয়ার্ড’ ছাড়া তার আর কোনো ছবিই ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। এরপর থেকে যে ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছে, সবগুলোই ফ্লপ করেছে। করোনাকাল শুরুর আগে থেকেই শাকিব খান অনেকটাই বেকার। বাধ্য হয়ে নিজের প্রযোজনায় ‘বীর’ ছবির কাজ করেছেন।
আরও পাঁচটি ছবি বানাবেন বলে বেশ জোরালো কণ্ঠে আওয়াজ দিয়ে আবার চুপসেও গেছেন। এরই মধ্যে বুবলীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে তিনি একঘরে হয়ে যান।
বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকাল শুরুর আগে কিছু চলচ্চিত্রপ্রেমী প্রযোজক শাকিবকে পারিশ্রমিক অর্ধেক করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। খান তাতে পাত্তা দেননি। উল্টো তিনি ৬০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক চেয়েছেন। শর্তও ছিল ব্যাপক যেমন- বিদেশে শুটিং, ছবির পরিচালক ও নায়িকা তার নিজের পছন্দের হতে হবে। এমনকি গানের শিল্পীও তিনি ঠিক করে দেবেন! এসব নিয়ে কম বচসা হয়নি ইন্ডাস্ট্রিতে।
Advertisement
এত ব্যাপৃত ছিল তার শর্ত! তাহলে পরিচালকের কাজটা কী? এই যখন অবস্থা তখন একে একে সরে গেলেন প্রযোজকরা। শাকিব খানের আশা ছিল ওপার বাংলার সিনেমা। কিন্তু হায়! সেখানেও নাকি বলে দেয়া হয়েছে, ‘নো মোর শাকিব’। কিন্তু কেন? তাহলে যে গত বছরের নভেম্বরে দৈনিক প্রথম আলোতে শাকিব খান ঘটা করে সাক্ষাৎকারে বললেন, ২০২০ সালে কলকাতার অর্ধডজন সিনেমায় অভিনয় করবেন তিনি! এখন তাহলে কী বলবেন খান?
প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয়। করোনার সময় যেখানে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় এবং কম ধনাঢ্য শিল্পীরা সাধারণ মানুষ ও সহশিল্পীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেন, তখনও খান ছিলেন নীরব। কেউ মুখ খুললে উল্টো তাদের বলেছেন, ‘কাউকে জানিয়ে কিছু করতে হবে নাকি? হুম!’
কেউ কেউ আবার টিপ্পনি কেটে বলছেন, আসলে উনি আর কী সহযোগিতা করবেন, করোনায় উনার যা ক্ষতি হলো তাতে করে, তারই প্রণোদনা পাওয়া উচিত। তিনি তো একবারে পথে বসে যাবেন না হলে।
শাকিব খান বারবার বলেন, তিনি সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কীভাবে? তার নমুনা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন আগে যা পারিশ্রমিক নিয়েছেন, এখন তিনি অর্ধেক বা তারও কম টাকা নেবেন। ভালো কথা। শাকিব খান কত টাকা পারিশ্রমিক নেন। শোনা যায় তিনি ৫০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন। এখন তিনি হয়তো বা ২০ বা ২৫ লাখ টাকায় ছবিতে অভিনয় করবেন। শাকিবের এমন ঘোষণাটি এমন সময় এল, যখন কোনো প্রযোজক আর নতুন করে সিনেমায় টাকা লগ্নি করার কথা ভাবছেন না। কারণ সিনেমা বানিয়ে চালানোর মতো প্রেক্ষাগৃহ নেই। টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কি সিনেমা হলে দর্শকরা যেতে পারবেন?
বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমাহলগুলো কি আবার খুলবে? আগের মতো নায়ক-নায়িকা কি সাবলীলভাবে আর অভিনয় করতে পারবে? অনেকগুলো প্রশ্ন যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন আর কেউই যেন টাকা বিনিয়োগ করতে সাহস পান না।
শাকিব খান সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়েছেন। ছবি নির্মাণের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু আমার প্রশ্ন, শাকিব আজকে আপনি ঘরে বসে আছেন, এমনি করে আজ থেকে এক বছর আগে অনেকগুলো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আপনার কারণে ঘরে বসে গেছেন। প্রযোজকরা কোটি কোটি টাকা হারিয়ে পথে বসে গেছেন। জানেন, এ জন্য আপনিই দায়ী। শুধু আপনার জন্য একটি সিনেমার খরচ বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। যা এই মন্দার বাজারে একটি সিনেমাকে অনেক বেশি ব্যাকফুটে নিয়ে গেছে।
আপনার কারণে অনেকগুলো সিনেমা ঈদে মুক্তি দিয়ে দুটি পয়সা পেতে পারত, সেখানেও তাদের বাধা দিয়েছেন। নিজের পছন্দের সিনেমা মুক্তি দেয়ার জন্য অন্যের সিনেমার ক্ষতি করিয়েছেন। আপনার কারণে বেশ কয়েকজন নায়িকা ক্যামেরা থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, বৈশ্বিক করোনা নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। আপনিও আর দশজনের মতো ঘরে বসে গেছেন। সিনেমা হাতে নেই। আপনার সম্পদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু কাজ না করে কতক্ষণ? আপনি বলেছেন, সিনেমাকে আপনি বাঁচাতে চান।
শাকিব খান, প্রায় তিনযুগ ধরে আমি চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা করছি। আপনার ওপরে আমার কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই। আমি প্রয়াত নায়ক সোহেল চৌধুরী, মান্না, সালমানের উত্থান দেখেছি, তাদের অকালমৃত্যু দেখেছি। রিয়াজ-ফেরদৌস, শাকিল খানদের উত্থান ও পতন দেখেছি। সিনেমায় আপনার আগমন দেখেছি। আপনার কষ্টার্জিত ক্যারিয়ার দেখেছি, সঙ্গে উত্থান পর্বও। আজ আপনার ভাগ্যাকাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার মেঘ। মনে মনে প্রার্থনা করি যেন মেঘ কেটে যায়। আপনি আবার নতুন করে নতুন উদ্যমে কাজ করুন। যারা আপনার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল, তাদেরকে সম্মান করুন। যারা আপনার জন্য কাজ করে, যে ছেলেটি আপনার পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দেয়, তাকেও ভালোবাসতে শিখুন। তবেই দেখবেন আপনার নায়ক জীবনে অনেক সফলতা আসবে।
এখন যেভাবে সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার কথা বলেছেন, এখানেও আপনাকে নিয়ে মানুুষ ভুল মেসেজ পাচ্ছে। সঠিক সময়ে আপনার যাত্রা পথের ট্রেনটি মিস করেছেন। বাংলা সিনেমার দুঃসময় আগেও এসেছে।
আমি দেখেছি, মরহুম মান্না একসময় দেখলেন কোনো সিনেমা চলছে না। সিনেমা কেন চলে না এ নিয়ে তিনি রীতিমতো গবেষণা করেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর প্রযোজকদের বলেছেন, ‘ভাই, সিনেমা বানান আপনারা, আমি কোনো টাকা নেব না। মনে চাইলে পরে টাকা দিয়েন।’
মান্না শুধু একা নন, তিনি তার নায়িকাদেরও অনুরোধ করেছেন যে এখন আগে সিনেমা হোক, সিনেমা ব্যবসা করলে, টাকা পাওয়া যাবে। এটি তো মাত্র একটি উদাহরণ। মান্না এমনি এমনি মানুষের কাছে এতটা প্রিয় নায়ক ছিলেন না। এমনি এমনি তার জন্য পুরো চলচ্চিত্র শিল্পের মানুষ পাগল ছিলেন না।
শাকিব, যখন আপনি বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন, তখন পারিশ্রমিক কমানোর কথা বলেছেন। সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়ার কথাও বলছেন। কিন্তু আপনার সামর্থ্য থাকার পরও চলচ্চিত্রের কোনো সমিতিতে কিংবা সরকারি কোনো তহবিলে করোনা মোকাবিলায় টাকা দেননি। কোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগও চোখে পড়েনি। অথচ আমরা পাশের দেশেই দেখি, তারা যে যেভাবে পেরেছেন, এগিয়ে এসেছেন দেশের অসহায় মানুষের জন্য।
শুধু পর্দার নায়ক হিসেবে নয়, কখনও কখনও বাস্তবের নায়কও হতে হয়। সেই নায়ক হয়ে উঠার চেষ্টা করুন আপনি।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি।
এইচআর/বিএ