দেশজুড়ে

হাতিয়ায় চরাঞ্চলে উচ্ছেদ আতঙ্কে শত শত পরিবার

ভোটার তালিকা হালনাগাদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ দান, ঠিকাদান কর্মসূচিসহ সব ধরনের যোগাযোগবিহীন ভীতিকর গ্রামে পরিণত হয়েছে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার হরণী ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর, তেগাছিয়া, টাংকির ঘাটসহ তিনটি গ্রাম। সম্পূর্ণ পুরুষহীন এ তিনটি গ্রামের মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি গত এক সপ্তাহ ধরে। শত শত পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন অতিবাহিত করছে। সরেজমিনে স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, হাতিয়া উপজেলার বয়ারচরের পশ্চিমাংশে দুর্গম এলাকা ১নং হরণী ও ২নং চান্দনী ইউনিয়ন। হরনী ইউনিয়নের পাশাপাশি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরলক্ষী ও চরগাজী ইউনিয়ন। দুই জেলার সীমানা সংলগ্ন হরনী ইউনিয়ন হওয়াতে প্রায় সময়ই রামগতির বেশ কয়েজন চিহ্নিত ও একাধিক মামলার আসামি দুর্ধর্ষ জল ও বনদস্যু বাহিনীর লোকজন এ হামলা করতো। তারা হরনী ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর, তেগাছিয়া, টাংকির ঘাটসহ বেশ কিছু জমি তাদের দাবি করে অত্র এলাকায় বসবাসরত নদী ভাঙ্গা মানুষের উপর হামলা চালিয়ে ফসলি জমির ধানসহ ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র, গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যেত। এছাড়া বাড়ি ঘরে প্রবেশ করে নারীদের উপরও নির্যাতন করতো। প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ থাকতো এসব এলাকার শত শত পরিবার। সীমানার বিরোধ নিয়ে পরবর্তীতে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়।  এছাড়া ২০০৫ সালে নোয়াখালী স্থানীয় সরকার (ইউনিয় পরিষদ) অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন) পরিষদ (সংশোধিত) আইন ১৯৯৩ এর ২০ ধারার বিধান অনুসারে হাতিয়া উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী অফিসার ইমাম উদ্দিন নবগঠিত ১নং হরণী ইউনিয়নকে ৯টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে এবং ২০ (এ) ধারা মোতাবেক ১নং হরণী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডকে ৩টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিভক্ত করে। সীমানা নিয়ে বিরোধ থাকায় ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. হুমায়ুন কবিরের নির্দেশে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের দুই জেলা প্রশাসক বসে হাতিয়ার হরনী ও রামগতির চরগাজী ইউনিয়নের মধ্যে আন্তঃ সীমান পিলারও দিয়ে দেয়।এরপর থেকে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে হরনী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বসতি গড়ে তোলা হাজার হাজার পরিবার সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। কৃষিকাজের পাশাপাশি মেঘনা নদীতে মাছ ধরে ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নদীভাঙা মানুষগুলো নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছেন। এলাকায় গড়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে জনবসতি। এদিকে ২০১০ সালে রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়ন থেকে ১৯৪১ জন ভোটারকে আদালত নির্বাচন কমিশনকে হাতিয়া উপজেলার হরনী-চান্দনী ইউনিয়নে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেন। সে নির্দেশনা মতে বর্তমানে দেশব্যাপী ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের আওতায় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় এ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৭ অক্টোবর  হরণী ইউনিয়নে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার জন্য গেলে পার্শ্ববর্তী রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের অস্ত্রধারী কয়েকশ সন্ত্রাসীরা হরনী ইউনিয়নে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহকারীদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং স্থানীয় সেন্টারবাজার বহুমুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। বাড়ি-ঘরে হামলায় অনেকেই আহত হন। সন্ত্রাসীরা এসময় তিন যুবককে তুলে নিয়ে যায়। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশকে অবহিত করা হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে অপহৃতদের উদ্ধার করে। মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়ার কারণে ভয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না গত এক সপ্তাহ ধরে। এ কারণে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারী বেলায়েত হোসেন জাগো নিউজকে জানান, ১৮ অক্টোবর সকালে তারা হরনী ইউনিয়নে ইপিআই কর্মসূচির আওতায় গ্রামে গিয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সময় চরগাজী থেকে সন্ত্রাসী এসে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। কোনোরকম প্রাণে বেঁচে আসেন তারা। এ পর্যায়ে সেখানে স্বাস্থ্য সেবা না দেয়ার কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার শিশু।হরণী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসকমোরশেদুর রহমান মীমাংসিত ইস্যুকে পুঁজি করে একদল সন্ত্রাসী আবার নিরীহ চরের মানুষের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে, সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদে ও তাদেরকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে হাজার হাজার নারী পুরুষ ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হরণী ইউনিয়নের মাইনুদ্দীন বাজারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।এসময় উপস্থিত হাতিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আজিম রাজু জাগো নিউজকে বলেন, আমরা হাতিয়ার লোকজন হাতিয়াতে থাকতে চাই। চরগাজী ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে যারা নিরীহ লোকজনের উপর হামলা, লুটপাট করছে এবং সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছেন দ্রুত তাদের গ্রেফতার করা হোক। এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক বদরে মুনিরের দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, রাগমগতির চরগাজী থেকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক এসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করে। এ খবর পাওয়ার পর পরই তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তারপর বিষয়টি নিয়ে লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক ও রামগতি ইউএনওর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি আরো জানান, বন্ধ থাকা বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুসহ সরকারি সেবা তথা ভোটার কাজ এবং স্বাস্থ্য সেবাও চালু করা হবে।মিজানুর রহমান/এমজেড/আরআইপি

Advertisement