ভারতে মঙ্গলবার করোনায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে। এদিকে দেশটির ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পড়েছে এক বিশাল সংকটে। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। অনেক রোগী পাঁচ-ছয় হাসপাতাল ঘুরে শেষে হাসপাতালের দরজায় মারা যাচ্ছেন। ভেতরে ভর্তি করানো যাচ্ছে না তাদের।
Advertisement
দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লি এবং বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) সাধারণ ওয়ার্ডে মারাত্মক শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো বেড ফাঁকা না থাকায় করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না। এই সংকট দ্রুত মোকাবিলা প্রয়োজন।
আজ মঙ্গলবার ভারতের জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির রাজ্য সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনিষ সিসোদিয়া বলেছেন আগামী জুলাইয়ের শেষ নাগাদ শুধু দিল্লিতেই আক্রান্ত সাড়ে ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মারাত্মক এই সংকট মোকাবিলা করার মতো হাসপাতালের সক্ষমতা নেই তাদের।
তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মঙ্গলবার এক বৈঠকের পর বলেন যদি সংক্রমণ এই পর্যায়ে যায় তাহলে তা মোকাবিলা করতে হলে ন্যুনতম আরও অন্তত ৮০ হাজার বেডের প্রয়োজন। তার এমস সতর্কতার কথ তখন প্রকাশ্যে এলা যখন দিল্লিতে হাসপাতাল জায়গা না পেয়ে রাস্তায় মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে।
Advertisement
দিল্লিতে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, প্রিয়জনের বলছেন, তারা তাদের রোগীকে নিয়ে সরকারি বেসরকারি নানা হাসপাতালে ঘুরেছেন কিন্তু কোনো হাসপতালেই তাদের স্বজনকে ভর্তি করানো হয়নি। কারণ হাসপাতালে বেড নেই। আর এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল করতে করতে তাদের রোগী মারা যাচ্ছেন।
দিল্লি এখন ভারতে করোনা সংক্রমিত শীর্ষ রাজ্যগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। প্রথম মহরাষ্ট্র, দ্বিতীয় তামিলনাডু। দিল্লিতে ২৯ হাজার ৯৪৩ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। যা ভারতের মোট শনাক্ত রোগীর ১০ শতাংশেরও বেশি। গোটা ভারতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের সংখ্যা ২ লাখ ৬৬ হাজারেরও বেশি।
দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামী ১৫ জুনের মধ্যে আক্রান্ত বেড়ে হবে ৪৪ হাজার। সেখান থেকে ১ লাখে পৌঁছাবে ৩০ জুন। আর ১৫ জুলাইয়ে সেই সংখ্যাটা হবে ২ লাখ ২৫ হাজার। ৩১ জুলাই হবে ৫ লাখ ৫০ হাজার। যদি এভাবে রোগী বাড়তেই থাকে তাহলে তা দিল্লি বিশাল এক সংকটে পড়ে যাবে।’
অঙ্কিত গোয়েল নামে দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আলজাজিরারে বলেন, ‘গত সপ্তাহে তার দাদুকে ছয়টি সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলেও কোনোটি তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। এমনকি হাসপাতালের ভেতরে নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। তাদেরকে বলা হয়, হাসপাতালে কোনো জায়গা ফাঁকা নেই।
Advertisement
তারপর উপায় না পেয়ে তার রোগী বেসরকারি একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কোনোরকমে ভর্তি করায়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসার খরচ এত বেশি যে তা তাদের পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না তাই হাসপাতাল থেকে রোগীকে নিয়ে আসা হয়। পরে ওই বৃদ্ধ মারা যান। এ নিয়ে একটি পিটিশন দাখিল হয়েছে।
অঙ্কিত গোয়েল বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবার চোখের সামনে দাদুকে চিকিৎসার অভাবে এভাবে মারা যেতে হলো।’ শহরের আরেক বাসিন্দা টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘তিনি তার অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সরকারি লোক নায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিন্তু তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
Delhi, Mumbai, Hyderabad, Chennai...Private hospitals turning away corona patients. Public hospitals overcrowded.Thanks to our political class for rotten healthcare system. When did they last speak or agitate on the issue of health policy? And why didn’t we question them?
— nikhil wagle (@waglenikhil) June 9, 2020ওই নারী লিখেছেন, ‘আমার বাবার জ্বর ছিল মারাত্মক। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন ছিল। আমি হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু কোনো ভাবেই আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমার বাবার করোনার সঙ্গে ছিল মারাত্মক জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট। কিন্তু সে চিকিৎসা পায়নি।’
এর কিছুক্ষণ পর তিনি আরেকটি টুইট করে জানান, তার বাবা মারা গেছে। সরকার তার বাবার চিকিৎসা সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’ তবে হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ওনার বাবা হাসপাতালে আসার পথেই মারা গেছেন বলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন।
তবে দিল্লির রাজ্য সরকারের এক অ্যাপে দেখা যাচ্ছে, দুই কোটি মানুষের ওই দিল্লির হাসপাতালগুলোর শয্যার সংখ্যা ৮ হাজার ৮১৪টি। এরমধ্যে অর্ধেক ইতোমধ্যে পূর্ণ। তালিকাভূক্ত ৯৬টি হাসপাতালের মধ্যে ২০টিতেই আর কোনো রোগী ভর্তি করানোর মতো অবস্থা নেই বলে জানানো হয়েছে।
ওই অ্যাপে আরও দেখানো হচ্ছে যে দিল্লির হাসপাতালগুলোতে মোটে ৫১৯টি ভ্যান্টিলেটর রয়েছে। এসবের মধ্যে ২৬০টি ব্যবহৃত হচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষ ভেন্টিলেটর সুবিধা পাচ্ছেন না। বিরোধী দল কংগ্রেসের এমপি মনিষ তিওয়ারি বলছেন, ‘দিল্লির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।’
ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র। আর রাজ্যটির রাজধানী মুম্বাই হলো ভারতের সবচেয়ে বড় ‘হটস্পট’। এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শহরটিতে ব্যবহার হচ্ছে এমন আর মাত্র ৩০টি আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে কয়েকদিনে তা পূর্ণ হবে।
ভারতীয় আরেক দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মুম্বাইয়ের হাসপাতালগুলোতে থাকা আইসিইউ বেডের ৯৯ শতাংশ এখন আর ফাঁকা নেই। এছাড়া ভেন্টিলেটরের ৯৪ শতাংশ রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হবে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে।
প্রতিদিনই দেশটিতে প্রায় দশ হাজার মানুষ করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সবশেষ হিসাব অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে আরও ৯ হাজার ৯৮৭ জন শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত বেড়ে হলো ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৮ জন।
সোমবার সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে অথচ ওইদিন থেকে করোনা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার বহর কমানোর কারণে শুরু হয়েছে তথাকথিত ‘আনলক-১’। বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় পুরোটাই আবার সচল। মৃত্যুর সংখ্যাও রীতিমতো উদ্বেগের। প্রতিদিন তিন শতাধিকেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।
সাবধান না হলে সামনে আরও তা ভয়ংকর হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেছেন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের (এইমস) মহাপরিচালক ডা. রণদীপ গুলেরিয়া। তিনি বলেছেন, আগামী ২–৩ মাস খুবই কঠিন সময়। কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই সংক্রমণ শীর্ষে পৌঁছাতে পারে।
এসএ