আসন্ন জাতীয় বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার পদক্ষেপ থেকে সরকারকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একইসঙ্গে অপর্যাপ্ত অর্থায়ন ও দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য খাতের সত্যিকার উন্নয়নে অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যাপ্ত বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং করোনোর প্রভাবে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানোর দাবি টিআইবির। শুধু বরাদ্দ বা আওতা বাড়ানোই নয়, এসব খাতে সব প্রকার ক্রয়, বিতরণ, ব্যয় ও বণ্টনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করে কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের রোডম্যাপের ঘোষণা ও এর বাস্তবায়ন দেখতে চায় সংস্থাটি।
Advertisement
মঙ্গলবার টিআইবির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই আহ্বানের কথা জানানো হয়।
টিআইবি বলেছে, 'সুশাসন ও ন্যায্যতার পরিপন্থী হলেও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সরকার আসন্ন বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগকে আরও বিস্তৃত করতে যাচ্ছে। আবাসন খাতে ফ্ল্যাটের পাশাপাশি এবার জমি কেনা ও উন্নয়ন এবং শেয়ার বাজারের বিনিয়োগেও এই অনৈতিকতার বৈধতা দেয়া হচ্ছে।'
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আসন্ন বাজেটে বড় পরিসরে আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগই কেবল দেয়া হচ্ছে না, বরং অর্থের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রশ্ন করার বিধানটিও উঠিয়ে দিতে যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদকে বৈধতা দেয়া শুধু পরস্পরবিরোধী নয়, বরং সরাসরি দুর্নীতি সহায়ক, অনৈতিক, অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক। বছরের পর বছর এই সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনীতির কোনো উপকার হয়নি, উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আদায় হয়নি, কোনো বিনিয়োগতো নয়-ই। অথচ অনৈতিকতা প্রশ্রয় পেয়েছে আর সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।'
Advertisement
তিনি বলেন, 'সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এই ব্যবস্থা সৎপথে উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক, এমন বাস্তবতায় সরকারকে এই আত্মঘাতী পদক্ষেপ থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া লক্ষাধিক কোটি টাকার যে খতিয়ান দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানে বিভিন্ন সময়ে বেরিয়ে এসেছে, তা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। অতি সম্প্রতি একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অজ্ঞাত উৎস থেকে দেশের বাইরে বিপুল বিনিয়োগের সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। সরকারকে এসব ‘দৃশ্যত আইনের ঊর্ধ্বে স্থান পাওয়া’ প্রভাবশালীদের আরও প্রশ্রয় দেয়ার পরিবর্তে সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করে উপযুক্ত কার্যকর জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বা জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সরকার এখনও মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষীর হাতে জিম্মি হয়ে যায়নি।'
'কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বল অবস্থা অত্যন্ত করুণভাবে ফুটে উঠেছে। সরকারি হাসপাতালগুলো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেবা না পেয়ে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে অসহায় মৃত্যুর খবরও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে', -বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য খাতের এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, “বছরের পর বছর স্বাস্থ্য খাতে অপর্যাপ্ত অর্থায়ন (যা বিব্রতকরভাবে জিডিপির এক শতাংশেরও কম), বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সমন্বিত কৌশলের অভাব আর এ খাতে ক্রমবর্ধমান লাগামহীন দুর্নীতি এহেন বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। যেখানে ক্রয় ও অবকাঠামো খাতের বরাদ্দকে স্বার্থান্বেষী মহল যোগসাজশ করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ বিকাশে এতটাই তৎপর থেকেছে যে, স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও সেবার মান বাড়ানোর বিষয়টি নিতান্তই উপেক্ষিত ছিল বলা যায়।'
এ খাতের দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে কাঠামোগত আমূল সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময় মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, “আসন্ন বাজেটে সরকার এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বা পথনকশা তুলে ধরবে বলে আশা করছি। যেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালুর সময়াবদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় দুর্নীতির মূলোৎপাটনের কার্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।'
Advertisement
'করোনা সংক্রমণ শুধু স্বাস্থ্য খাতেরই নয় দেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকেও মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। ভয়াবহ এই সংকট যে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের বড় সংখ্যক মানুষকে শুধু কর্মহীন করে তুলেছে তাই নয় বরং ঠেলে দিয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচেও।'
অর্থনৈতিকভাবে অসহায় এসব মানুষের কর্মসংস্থানের গুরুত্ব উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র মানুষের জন্য নির্ধারিত সহায়তা আত্মসাতে তৎপর স্বার্থান্বেষী মহলকে নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কর্মকৌশল নেয়া আবশ্যক, যার ঘোষণাটি আসতে হবে আসন্ন বাজেটেই। এ ক্ষেত্রে শুধু বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্তির যোগ্য সব উপকারভোগীর কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলে নিয়মিত হালনাগাদ অবস্থায় ওয়েবসাইট ও অন্যান্য সহজে অভিগম্য মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে এবং প্রযুক্তির কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ কমিয়ে আনায় গুরুত্ব দিতে হবে।'
জেডএ/জেআইএম