চিকিৎসক আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে খুলনা জেলার ৯ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়েছে। অধিকাংশ স্থানে কাগজে-কলমে চিকিৎসক থাকলেও বাস্তবে রয়েছে শূন্য। ইউনিয়ন পর্যায়েও একই চিত্র বিরাজ করছে। জানা গেছে, কমপ্লেক্সগুলোতে কর্মরত চিকিৎসকরা নিয়মিত উপস্থিত না থাকায় উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা সরকারি চাকরি না করে শহরে নিজস্ব ও প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়ে পার করছেন তাদের ব্যস্ত সময়। ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকরাও থাকছেন না কর্মস্থলে। ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রসূতি মায়েরা সময়মত চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় অধিকাংশ সময়ে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত ওষুধ, খাবার (ডায়েট) সরবরাহও করা হয় না বলে অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাবাসীর। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে চিকিৎসকদের মোট ১৭টি পদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেসথেসিয়া) ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারের ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে জলমা, বটিয়াঘাটা, গঙ্গারামপুর, সুরখালী, ভান্ডারকোট, বালিয়াডাঙ্গা, আমিরপুর ইউনিয়নে ১ জন করে সহকারী সার্জন আছে। এছাড়া উপজেলার সুরখালী, ভান্ডারকোর্ট ও জলমা ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নেই। স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের অনিয়মিত উপস্থিতি চিকিৎসা সেবা গ্রহণে প্রধান সমস্যা বলে মনে করছেন এলাকার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। ইউনিয়ন পর্যায়ে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসাসেবা না থাকায় অধিকাংশ সময়ে মা ও শিশুর মৃত্যও ঘটে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৭২টি গ্রামে ৪০ হাজার ৭৭৯টি পরিবার ও সর্বশেষ আদমশুমারির গণনা মতে, ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৫২ জন মানুষের বসবাস রয়েছে। কাজিবাছা, শৈলমারী, পশুর ও ভদ্রা নদী সংলগ্ন এ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এখনো উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে চিকিৎসকদের মোট ৩১টি পদের মধ্যে ১৭টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। শুধুমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ জন চিকিৎসকের মধ্যেই ১০ জনই নেই। এছাড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে দাকোপ, পানখালী, সুতারখালী, কামারখোলা, তিলডাঙ্গা, বাজুয়া, ও বানিশান্তা ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রয়েছে চিকিৎসক শূন্য। শুধুমাত্র লাউডোব ও কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের দু’টি কেন্দ্রে ১ জন করে সহকারী সার্জন রয়েছেন।সুতারখালী, কামারখোলা ও বানিশান্তা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া দাকোপ সদর ও পানখালী ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নেই। সুন্দরবন সংলগ্ন এ উপজেলাতে ৯টি ইউনিয়ন, ১০৬টি গ্রাম রয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি জরিপ মতে, এখানে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৯ জন মানুষের বসবাস। দাকোপ উপজেলার মধ্যে রয়েছে চালনা পৌরসভা। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানকার সাধারণ মানুষ উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। সুন্দরবন ও নদী সংলগ্ন এলাকার সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেও উন্নত চিকিৎসার অভাবে মারা যান। এছাড়া পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে উপজেলার শিশুরা আক্রান্ত হলেও সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধির। রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে চিকিৎসকদের মোট ১৫টি পদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেসথেসিয়া) ও মেডিকেল অফিসার ২টি পদ শূন্য রয়েছে। উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে আইচগাতী, শ্রীফলতলা, নৈহাটি, টিএস বাহিরদিয়া, ঘাটভোগ ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কাগজে কলমে ১ জন করে সহকারী সার্জন আছে। এছাড়া উপজেলার তিলক স্বল্প বাহিরদিয়া ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়নের কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসকদের বেসরকারি ক্লিনিকের বাণিজ্যে ও সরকারি কর্মস্থলে অনিয়মিত উপস্থিতির কারণে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার মানুষ। ৭৮টি গ্রামে সরকারী হিসাব অনুযায়ী, ৩৪ হাজার ৩৫৯টি পরিবারের মধ্যে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬০৪ জন মানুষের বসবাস এখানে। তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৪টি পদই শূন্য রয়েছে। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে চিকিৎসকদের মোট ১৬টি পদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেসথেসিয়া), আবাসিক মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার (ইউনানী) ও ডেন্টাল সার্জন নেই। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে আজগড়া, বারাসাত, ছাগলাদাহ, সাচিয়াদাহ, তেরখাদা ও মধুপুর ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কাগজ কলমে ১ জন করে সহকারী সার্জন আছে। এছাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নেই। জেলা সদর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরত্ব এ উপজেলার। সর্বশেষ আদমশুমারির গণনা মতে, ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৫৪ জন মানুষের বসবাস এখানে। ১০০টি গ্রামে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২৬ হাজার ৩০৪টি পরিবার রয়েছে। এ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এখনো উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় দেড় লাখ মানুষের জন্য ১৬ জন চিকিৎসক রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত কর্মস্থলে আসেন না বলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী জানান। ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫ চিকিৎসকের মধ্যে ৫টি পদই শূন্য। যারা আছেন তারাও নিয়মিত হাসপাতালে আসেন না। সাধারণ মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছনে। ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে কাগজ-কলমে ২৪ জন চিকিৎসক থাকলেও বাস্তবে তা নেই। শহরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা। এছাড়া পাইকগাছা উপজেলায় ২১ জনের মধ্যে ৯ জন ও কয়রা উপজেলায় ৮ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। এ বিষয়ে বটিয়াঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খান জাগো নিউজকে জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা নিয়মিত অফিস করেন না। তারা খেয়াল খুশি মতো আসেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা কর্মস্থলে যোগদান করেন না। যে কয়েকজনও আসেন তাও আবার অনিয়মিত। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্সরে মেশিনটি শুরু থেকেই ১৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নেই কোনো সরকারি ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ইউনিয়নের কেন্দ্রগুলোর জরাজীর্ণ ভবন। এ বিষয়ে বহুবার জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় সিভিল সার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি বলে জানান এ জনপ্রতিনিধি। দাকোপ উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শেখ আবুল হোসেন জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নিজেই কাগজ-কলমে অফিস করলেও এখানে আসেন না। খুলনা শহরের নিজস্ব ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৫০ শয্যার অনুকূলে যে সমস্ত ওষুধ ও খাবার বরাদ্দ রয়েছে তাও সঠিকভাবে দেয়া হয় না। এ নিয়ে অনেকবার সিভিল সার্জনসহ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সরফুদ্দিন বিশ্বাস বাচ্চু জাগো নিউজকে জানান, আমাদের পরিবারের কারো অসুখ বিসুখে সরকারি যে সেবা আছে তাও সঠিকভাবে পাই না। স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ২০/২২ মাইল পথ পেরিয়ে শহরের হাসপাতালে যেতে হয়। এতে গরীব পরিবারগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান খান আলী মুনসুর জাগো নিউজকে জানান, জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় কিন্তু বাস্তবে কোনো সুফল পাওয়া যায় না। নিয়মিত আসেন না স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা। এলাকার জনগণ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মো. ইয়াসিন আলী সরদার জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সিভিল সার্জন দফতর থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও নজরদারি রাখা হচ্ছে। চিকিৎসা সেবা প্রদানে অবহেলা ও নিয়ম বর্হিভূত কর্মকাণ্ডের কোনো খবর আমাদের কাছে নেই।এসএস/পিআর
Advertisement