দেশজুড়ে

কুড়িগ্রামে আলো ছড়াচ্ছে গোলাপ খাঁ শিশু সদন

কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী শহরের ‘গোলাপ খাঁ শিশু সদন’ ৭ বছর ধরে অনাথ শিশুদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে আসছে। আর কর্ণধার হিসেবে বিলকিস বানু নিরবে নিভৃত্বে কাজ করে যাচ্ছে। আলো ছড়াচ্ছে বাপ-মা হারা এতিম শিশুদের অন্তর জুড়ে। জানা গেছে, মায়ের মমতার পাশাপাশি অনাহারীদের মুখে অন্ন তুলে দেয়া, তাদের সামাজিকভাবে পরিচয় প্রদান, একাকিত্বের বেদনা ভুলিয়ে দিয়ে মায়ের মমতার বন্ধনে বেঁধেছেন তিনি। পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে। এমন অনন্য এক নজির গড়ে তুলেছেন বিলকিস বানু। এই কাজে অনেক বাঁধা-বিপত্তি থাকলেও থেমে যাননি। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন এই পথ শিশুদের পিছনে। আয়ের সবটা ব্যয় করেও পিছু হটেননি। বিপদে কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা রেখেই আরো বড় কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এ রকম একটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করে উত্তর জনপদে নজর কেড়েছেন নাগেশ্বরী উপজেলা শহরের বাসিন্দা বিলকিস বানু। বিলকিস বানু বর্তমানে ৫১ জন বাপ-মা হারা এতিম সন্তানের মা।কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নাগেশ্বরী উপজেলা শহরের নাগেশ্বরী ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বিলকিস বানুর আবাসিক ‘গোলাপ খাঁ শিশু সদন।’ ২০০৯ সালে ১৩ জন অনাথ শিশুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। মোট ১ একর জমির উপর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৫১ জন বাপ-মা মরা অনাথ শিশু রয়েছে। এর মধ্যে মেয়ে রয়েছে ১৬ জন এবং ছেলে রয়েছে ৩৫ জন। দুইটি বড় হলরুমে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা থাকার ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানের নিজ খরচে ও ব্যবস্থাপনায় শিশুদের ক্যাডেট পদ্ধতিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি শরীরচর্চা শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে।পরিচালক বিলকিস বানু জানান, নাগেশ্বরী বাজারের রাস্তার পাশে ১৯৯৭ সালে জন্ম নেয় এক নাম পরিচয়হীন শিশু। ওর মাকে সবাই ঝর্না পাগলি নামে জানত। সারাদিন বাজারেই থাকতেন তিনি। কেউ দিলে খেত, না দিলে অনাহারে থাকত। বাড়ি থেকে বিতাড়িত এই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীও বিকৃত লোলুপ লালসার শিকার হলে ওই শিশুর জন্ম হয়। এই বাজারেই ছিল বিলকিস বানুর মার্কেট ও বাসা। প্রতিদিন বাইরে যেতে আসতে শিশুটিকে দেখে তার মায়া জন্মে। ঝড়-বৃষ্টি, কনকনে শীতে কষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠছিল শিশুটি। না খেতে পেরে হাড্ডিসার হয়ে যায়। মানসিক ভারসাম্যহীন ঝর্ণা পাগলি শিশুটির যত্ম নিতে পারছিল না। নভেম্বরের এক কনকনে ঠান্ডায় শিশুটিকে মনে হচ্ছিল মারাই যাবে। বিলকিস বানু ঘটনাটি দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না। ১৯৯৯ সালের কথা। তিনি সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলেন। জন্ম পরিচয়হীন শিশুটির বয়স তখন ২ বছর। এই কাজে তার স্বামীরও সমর্থন ছিল। বাড়িতে এনে শিশুটির নাম দেয়া হল ‘প্রীতিলতা’। এই পরিচয়ে এই বাড়িতেই বেড়ে উঠছিল প্রীতিলতা। এভাবে অনাথ শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে বিলকিস বানু নিরাপত্তা আর সামাজিক পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলেন। এই ধরনের কাজে যুক্ত হয়ে তিনি মন থেকে এক ধরনের ভাল লাগা অনুভব করলেন। মনে হল এই অনাথ শিশুর সত্যিকারের মা তিনি। প্রীতিলতার পরিচয় সামাজিকভাবে দেয়ার জন্য তাদের নিজ মার্কেটের নাম বদল করে রাখালেন ‘প্রীতিলতা মার্কেট’। এভাবেই প্রীতিলতার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর এতে আগ্রহী হয়ে অনেকেই এ রকম শিশুর সন্ধান দিতে লাগল। যাতে প্রীতিলতার মতো তারাও এই পরিবারে আশ্রয় পায়। এভাবে ৯টি শিশু এই বাড়িতে আশ্রয় পেল। শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় থাকা ও খাওয়ার সমস্য হচ্ছিল। তখন বিলকিস বানু প্রীতিলতা মার্কেটের ৪০টি দোকানঘর থেকে যে ভাড়া আদায় হত তা এতিম শিশুদের পিছনে খরচ করতে লাগলেন। এই শিশুদের নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠার জন্য শ্বশুরের ১ একর জমিতে গড়ে তুললেন নতুন ভবন। এভাবে প্রীতিলতা থেকে যাত্রা শুরু হল ‘গোলাপ খাঁ শিশু সদন’ এর। জানা গেল, গোলাপ খাঁ শিশু সদনে শিশু শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেয়া হয়। এখানে ৮ জন শিক্ষক ও ৫ জন সাপোর্ট কর্মী রয়েছে। শিশুদের পাঠদানের জন্য রয়েছে ৩টি অবকাঠামো। ১টি রান্নাঘরসহ ২টি থাকার হলরুম। রয়েছে ১টি মসজিদ। প্রতি মাসে এই সদনের জন্য ব্যয় মেটাতে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ টাকা। যার মধ্যে শিক্ষকের বেতন ৩২ হাজার টাকা, সাপোর্ট কর্মী ৮ হাজার টাকা, বিদ্যুত-পানির বিল ৩ হাজার টাকা, তিনবেলা খাবার বাবদ ৫২ হাজার টাকা। এছাড়াও পোশাক রয়েছে। এই বিপুল অংকের অর্থ সংকুলান করা কষ্টসাধ্য হলেও পিছু হটেননি বিলকিস বানু। বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের সচেতন মানুষের সহায়তায় তিনি এগিয়ে চলছেন আলো ছড়াতে। বর্তমানে আয় বলতে নিজস্ব প্রীতিলতা মার্কেট থেকে ভাড়া বাবদ ৪০ হাজার টাকা, ছাত্রাবাস থেকে আয় ১৬ হাজার টাকা। এই শিশু সদনের শিক্ষার্থী প্রীতিলতা (১৭) জানান, এখানে আমার খুব ভাল লাগে। এখানে বাবা-মায়ের আদর পাচ্ছি। অন্যান্য শিশুরা আমাকে বড় বোন হিসেবে সম্মান দেয়। আমিও তাদের আদর করি। আমরা সবাই ভাই-বোনের মত বেড়ে উঠছি।বিলকিস বানুর স্বপ্ন এই শিশু সদনের জন্য একটি নিজস্ব খোলা জায়গা ঠিক করা। যেখানে অবকাঠামোসহ খেলার মাঠ থাকবে। এজন্য নিজস্ব জমি বিক্রি করে তিনি নাগেশ্বরী হেলিপ্যাড এলাকায় ৩ একর জায়গা ঠিক করে ফেলেছেন। এখানে শিশু সদন করা গেলে খেলার মাঠও করা যাবে। এছাড়াও তার ইচ্ছা অনুযায়ী শিশু সদনের আসন সংখ্যা দুইশতে উন্নীত করতে চান। শিশুদের যত্ম নিতে তার ভাল লাগে। এই কাজে তার স্বামী নাগেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক রবিউল ইসলাম রবি অর্থ-সম্পদ উজাড় করে সহায়তা করছেন। আর সে কারণে তার এতদূর পথ চলা সম্ভব হয়েছে।  তাদের একমাত্র সন্তান সূর্যও সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করছে মাকে।অধ্যাপক রবিউল ইসলাম রবি বলেন, অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে গোলাপ খাঁ শিশু সদন সমাজে একটা জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এর আগামী দিনের পথ চলা এবং এটির সম্প্রসারণ ঘটাতে প্রয়োজন সরকার এবং বে-সরকারি পর্যায়ের সার্বিক সহায়তা। এসএস/পিআর

Advertisement