২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটে ১০টি খাতে অগ্রাধিকার দেয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বৃহস্পতিবার (৪ জুন) সংগঠনের আমির ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান।
Advertisement
কার্যকর সুশাসন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং সকল স্তরে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মহামারিতে রূপ নেয়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য সরকার বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এবারের বাজেট মূলত অর্থনীতিকে টেনে তোলার বাজেট। বাজেটে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পাসপোর্ট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার এবং বৃহৎ প্রকল্পসমূহকে দুর্নীতিমুক্ত করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ সকল প্রতিষ্ঠানের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক সনদ মেনে চলতে হবে। সকল প্রকার জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ সংস্কার করা, যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা এবং দুর্নীতি যেন অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক না হতে পারে।’
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার তা সংক্ষেপে তুলে ধরেন জামাতের আমির।
সেগুলো হলো-
Advertisement
কর এবং রাজস্ব- সরকারকে সেবাখাত বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি নির্ভর খাতসমূহকে ক্রমান্বয়ে ভ্যাটের আওতামুক্ত করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণের সামর্থ্য এবং বাস্তবতার আলোকে কর নির্ধারণ করা। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অযৌক্তিক ব্যয় থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে আসা। তামাকজাত দ্রব্য, বিলাস দ্রব্য এবং প্রসাধনীর ওপর উচ্চমাত্রায় করারোপ করা এবং এসবের আমাদানি ও ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা।’
ওয়াকফ সম্পত্তি- এর সংরক্ষণ ও ব্যবহারে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া যাতে জাতীয় মূল্যবান এ সম্পদগুলো থেকে রাষ্ট্র উপকৃত হয় এবং অবৈধ দখলদার মুক্ত হয়।
বিদ্যুৎ- কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকট থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের মূল্য কমানোর ব্যবস্থা করা। যেহেতু তারা সরাসরি ফুয়েল আমদানি করতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ফুয়েলের মূল্য কমেছে। তাই বিদ্যুতের মূল্য কমিয়ে জনগণের ওপর থেকে বাড়তি আর্থিক চাপ কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সোলার পদ্ধতিকে বিকশিত করতে হবে।
স্বাস্থ্য- নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। বাজেটে এটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন, তারা কার্যত এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পুনর্বাসনের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা একান্তই জরুরি। জরুরি তহবিল গঠন করে আপদকালীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী জনশক্তির বিন্যাস সাধন করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বীমা চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। এবং সরকারি তহবিল থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতাল সেবা থেকে উদ্ভূত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
Advertisement
দারিদ্র দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি- দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ একেবারেই শূন্যের কোটায় বললেই চলে। এটা বাড়াতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সকলের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে ভর্তুকি মূল্যে দরিদ্র জনগণকে স্বচ্ছতার সঙ্গে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বিশেষ আনুকূল্যের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য লাভ মুক্ত ঋণ বরাদ্দ দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। এটা দ্রুত পরিবর্তন করে স্বচ্ছ, সঠিক এবং ন্যায্য তালিকা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষিখাত- বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হলো কৃষি। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে। কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে কৃষক ও কৃষিপণ্যকে নিরাপদ রাখতে হবে। কৃষক ও কৃষিখাতকে রক্ষার জন্য কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি ধান ও কৃষিজাতপণ্য ক্রয় করতে হবে। ধানের মূল্য প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকা হওয়া উচিত। কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু বিপণন ও কৃষকরা যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় সে লক্ষ্যে কৃষি পণ্য বহনের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেন এবং সড়ক পথে পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ‘চাষির বাড়ি, বাগান বাড়ি’ ধারণার ভিত্তিতে বাড়ি-ঘরের জমিসহ ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পোল্ট্রি, ফিসারিজসহ গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ গুরুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে।
শিক্ষা- সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোতে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও আমাদের দেশে তা হচ্ছে না বললেই চলে। শিক্ষা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের ছাত্র সমাজ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়ছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠান বন্ধকালীন সময়ে অনলাইনে সকল স্তরে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া দরকার। শিক্ষা-গবেষণা ফান্ড তৈরি করা এবং তা রাজস্ব খাতের আওতায় নেয়া দরকার। ছাত্রদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে সুযোগ সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ব্যবসা ও রফতানি বাণিজ্য- করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের রফতানি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আসন্ন বাজেটে এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি ও শিল্পকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে কৃষিভিত্তিক রফতানি বিন্যস্ত করতে হবে। বৃহৎ শিল্পকারখানা, ব্যাংকিং সেক্টরের বিনিয়োগকে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতিমুক্ত করা। এক্ষেত্রে ঋণ-সীমা পুনর্বিবেচনা করা। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ সততা, সচ্ছতা এবং কার্যকরভাবে কাজে লাগানো। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে পূর্ণ পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা। শক্তিশালী পেশাদার ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা, যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে। সেইসঙ্গে সরকারকে ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে হবে। অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ- দেশ ও দেশের জনগণকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ পরিবেশের বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। ব্যাপক বনায়নের দিকে নজর দিতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা- অতি সম্প্রতি সুপার সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত ২৬টি জেলার রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট বিশেষকরে বেড়িবাঁধ নির্মাণে বাজেটে বরাদ্দ থাকতে হবে। আম্ফানে যারা নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবারের পুনর্বাসনেও বাজেটে বরাদ্দ থাকা দরকার।
প্রবাসীদের পুনর্বাসন- করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার শিকার হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কর্মহারা অবস্থায় দেশে ফিরে আসছেন। রেমিট্যান্সযোদ্ধা হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। যেসব শ্রমিকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারের ও কর্মহারা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ থাকতে হবে।
কেএইচ/এফআর/এমকেএইচ