করোনার বিপর্যয়ের মধ্যে যখন দেশ-বিশ্ব স্তব্ধ, দেশ মহামারি বা খাদ্য-অর্থ সংকটের মধ্যে পড়বে কিনা এ নিয়ে যখন সবাই উদ্বিগ্ন, তখন করোনা পরিমণ্ডলের বাইরে এমন কতক অনভিপ্রেত-দুর্ভাগ্যজনক-নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে, যা বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না, ধারাবাহিকতা নিয়েই জাতির মর্মমূলে বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যক্তি মানুষকে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোড়িত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো তিনটি ঘটনা নিয়ে এখানে আলোকপাত করা হলো।
Advertisement
এক হৃদয়বিদারক কাহিনীর মধ্যে সামনের সারিতে থাকবে বাউল শিল্পী রণেশ ঠাকুরের বাড়ি, গানের বইপত্র, বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার ঘটনা। এই বাউল শিল্পীর ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। এলাকায় বাউলগুরু আব্দুল করিমের শিষ্য ও সাধক হিসেবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তিনি। প্রসঙ্গত বিগত জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলে বাউল সাধক শরিয়ত সরকার ও রীত দেওয়ানের বিরুদ্ধে যেমন ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ উঠেছিল, তেমন ধর্মীয় কটূক্তির কোনো অভিযোগ এই বাউল সাধকের বিরুদ্ধে নেই। তবুও এই নিরপরাধী সর্বস্বান্ত হলেন। এই অগ্নিসংযোগ ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বাড়ির ওপর হলেও এটা মূলে হচ্ছে গ্রামবাংলার হাজার বছরের লোকায়ত সংস্কৃতি ও শিল্পের ওপর আঘাত। এটা তো সর্বজনস্বীকৃত বাউলরা জাত-ধর্ম মানেন না, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান, জীবন দিয়ে দেখায় জাত-ধর্ম পরমগুরুর নয়, মানুষের সৃষ্টি। লালন বলে, ‘যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,/নারীর তবে হয় কী বিধান??/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কীসে রে।’ বাউলের গান সাধনায় রয়েছে দেহতত্ত্ব, নিগুঢ় তত্ত্ব, মানুষ ভজনা, অন্তর্লোক, আধ্যাত্মবাদ, ভক্তি, বিচ্ছেদ প্রভৃতি। প্রকৃত মালিক পরম গুরুর মরমীসাধক তারা। আত্মশুদ্ধির সন্ধানে রত, রিপু দমনে সচেষ্ট। উৎপীড়ন অত্যাচার অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং প্রগতিমুখীন, অসাম্প্রদায়িক মুক্তচেতনার গান ও সুরের ভেতর দিয়ে তুলে ধরে।
এই কারণে পাকিস্তানি আমলে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে বাউলরা ছিলেন বিবেক হিসেবে জাতির সামনে। লালন, হাসন রাজা, রাধারমণ প্রমুখ সাধক আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা আমাদের জাতির মূলধারার সাথে মিশে আছেন। লোকজ সংস্কৃতি, যাতে রয়েছে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দেশের মাটিতে সংশ্লেষণের ধারা, যে ধারার অন্তর্নিহিত শক্তির কারণেই ওই দুই ধর্মের মানুষ শত শত বছর পাশাপাশি বাস করতে পেরেছে, সেই ধারার অন্যতম রক্ষক ও বাহক হচ্ছেন বাউল সাধকরা। এই ধারা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম বিবেক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অতি প্রিয় ও কাছের ছিলেন। অক্ষরজ্ঞান কিছু ছিল না এই সাধকের, তবু তখন জাতির মনের কথা বলতে পেরেছিলেন গানের সুরে। ‘বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে,/ মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে! / সামন্তবাদ জালিম বটে, দয়া নাই তাহার মনে।’ বাউলদের বিরোধীরা যখন হানাদার বাহিনীর দালাল-ঘাতক, তখন অনেক বাউল মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। সত্য কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে ‘ভুবন মাঝি’ সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। বাউলরা আমাদের জাতির রক্তের সাথে মিশে আছে, আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর কবিগুরু নিয়েছিলেন, মরমী গায়ক গগণ হরকরার একটি গান থেকে।
তাই সাধক বাউলের ওপর আঘাত মানে আমাদের জাতির মর্মমূলে আঘাত, স্বাধীনতার চেতনার ওপরে আঘাত, জাতীয় চার মূলনীতির ওপর আঘাত। পঁচাত্তরের পর থেকে বাউলদের ওপর নানাভাবে উৎপীড়ন নির্যাতন করা হচ্ছে। চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া, গ্রাম থেকে বের করে, পরিবারের কাউকে জানাজা না পড়ানো প্রভৃতি তাদের যেন কপাল লিখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভাবলে বেদনাহত হতে হয়, বর্তমানে আওয়ামী লীগ শাসনামলেও এমন হচ্ছে। একদিকে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম একুশে পদক পায়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে এই সম্রাটের গান শুনেছেন আর অন্যদিকে করোনাদুর্যোগের মধ্যে তাদের একজনের বাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক বাউলরা করোনাদুর্যোগের মধ্যে অভাবে থাকলেও নাকি ত্রাণ পাচ্ছেন না। বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের পুত্র বাউল শাহ নুরজালালসহ সুনামগঞ্জের অনেকে বাউল সাধক অভিযোগ করেছেন, আমরা ত্রাণের খাদ্যও পাইনি, ত্রাণের টাকার তালিকায়ও আমরা নেই।
Advertisement
এইসব নিরাশার মধ্যেও আশার কথা, বাউল রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে আগুন দেওয়া সন্দেহে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাড়ি তুলে দিতে চেয়েছেন জেলা প্রশাসক। দিয়েছেন নগদ ২০ হাজার টাকা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাঁর বাদ্য যন্ত্রপাতি দেবে বলে জানিয়েছেন। সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগও পাশে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, কলামটা যখন লিখছি, তখন শেষ হয়ে গেছে বাউল রণেশ ঠাকুরের বাড়ি পোড়ানোর প্রতিবাদে অনলাইন কনসার্ট, যাতে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও প্রবাসের বিশিষ্ট বাউলরা অনলাইনে গান গাইবেন। কনসার্টটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাদ্যহারা বাউলা গান’। যন্ত্রপাতি পুড়ে যাবার প্রেক্ষাপটে নামটা খুবই আবেগময়। বাস্তবেই বাদ্যযন্ত্র, গানের বই সব পুড়ে ছাই করে দিলেও কণ্ঠ রুদ্ধ করা অসম্ভব। কণ্ঠ নিঃসৃত লোকজ গান ও সুরের মৃত্যু নেই। লালনকেও কম অত্যাচার সহ্য করতে হয় নাই। মৃত্যুর ১৩০ বছর পার হলেও লালন আজ জীবন্ত, তাঁর গান ও সুর মানুষের মুখেমুখে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন থাকবেন লালন ও বাউল সাধকরা। কিন্তু যারা অত্যাচার করছে, তাদের অবস্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
দুই.
করোনাদুর্যোগের মধ্যে মে মাসের প্রথম দিকের এক সকালে ‘করোনাযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব ও বাংলাদেশ’ কলামটি একটি দৈনিকে প্রকাশের পর প্রবাসী এক বন্ধুর টেলিফোন পেলাম। রাগত স্বরে বললেন, ‘বিশ্ব-দেশ প্রভৃতি সব নিয়ে লিখছেন। ঠিক আছে লিখেন। কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে অত্যাচার হচ্ছে, তা লেখেন না কেন?’ কোনো কথাই শুনতে চাইলেন না বন্ধুটি। একসময় রাগ করে টেলিফোনটি রেখে দিলেন। এমন টেলিফোন দেশ-বিদেশ থেকে প্রায়ই পাই। ইতোমধ্যে উল্লিখিত কলামটি ফেসবুকে দেওয়ার পর কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মন্তব্য পড়লাম। কেউ অনুযোগ করেছেন এই ইস্যুতে লিখি না বলে আর কেউ দেশে করোনার মধ্যে তখন পর্যন্ত কতটা সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেই তথ্য দিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না, করোনার মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ত্রাণমন্ত্রীর কাছে যথাক্রমে গত ২৯ এপ্রিল ও ৪ এপ্রিলের স্মারকলিপি দুটো পড়ে এমনভাবে ক্ষেপে কেউ কেউ কথা বলছেন বা মন্তব্য করছেন।
প্রথম স্মারকলিপিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ২৭টি ঘটনার সংক্ষিপ্তসার সংযোগিত করে বলা হয়েছে, ‘দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এরা ভবিষ্যতে আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্ন সৃষ্টিতে অধিকতর তৎপর হয়ে সরকারের ভাবমূর্তিই কেবল বিনষ্ট করবে না, বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।' দ্বিতীয়টিতে লেখা হয়েছে, ‘ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যেকার পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নিম্নবিত্ত হরিজন জেলে দলিত রবিদাস ও আদিবাসী সম্প্রদায় যাতে ত্রাণের বাইরে না থাকে তজ্জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণে আপনারা মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।’ তবে ওই সংগঠন সূত্রে জানতে পারলাম, স্মারকলিপি দেওয়ার পর দুর্বৃত্তদের অশুভ কর্মকাণ্ডে কিছুটা ছেদ পড়েছিল। এখন আবার বেড়ে যাচ্ছে। আর ত্রাণ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয় নাই। প্রসঙ্গত সরকারি ত্রাণ তৎপরতা ও দুস্থ পরিবারগুলোকে অর্থপ্রদান করবে জানার পর সংগঠনটি উৎসাহিত হয়েছিল এবং এ জন্য একটি ধন্যবাদপত্রও প্রধানমন্ত্রীকে প্রেরণ করেছিল। কিন্তু তালিকার পর দেখা যাচ্ছে তাতে বৈষম্য থেকে গেছে। সংগঠনটি কয়েকদিনের মধ্যেই জেলাভিত্তিক দুস্থদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করবে বলে জানা গেছে।
Advertisement
বর্তমানের এই চিত্র যখন চোখের সামনে ভাসে আর বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যখন প্রায় ৫০ বছর আগের দিনগুলোর কথা ভাবে, তখন স্বপ্ন আর বাস্তবের আকাশ পাতাল ফারাক উপলব্ধি করে। তদুপরি বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকলে আরও কতটা বিপদ বাড়তো তা যেমন বিবেচনায় নেয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকতে এমনটা হবে না বলেই একটা বিশ্বাস দানা বেঁধে উঠেছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না বলে ক্ষোভ ও অভিমানে উল্লিখিত ধরনের প্রতিক্রিয়া দাঁড়াচ্ছে। কারো কারো প্রতিক্রিয়াটা এতই প্রবল যে, দেশ-উপমহাদেশ-বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি বিষয়ে যে গণমনস্তত্ত্বে ও বাস্তব জীবনে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, সব ধর্মমতের মানুষের মধ্যেই সাধারণভাবে যে সেসব ধস নেমেছে; তা বিবেচনায় নিতে পারছেন না। তখন ছিল উত্থানের সময়কাল আর এখন ক্রমাগত পতন হচ্ছে। সমাজটা হয়ে পড়ছে যেন তৈলাক্ত বাঁশ, নিচে নামাটা যত সহজ উপরে ওঠাটা ততই কঠিন।
মুজিববর্ষ তাই মনে পড়ছে, ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ওয়ারি উপদ্রুত এলাকায় জীবন বাঁচাতে গিয়ে ৪৪ বছর বয়সী নেতা শেখ মুজিবের জীবন বিপন্ন হয়েছিল, বিক্ষুব্ধ হয়ে ইত্তেফাক অফিসে দাঙ্গা প্রতিরোধে সর্বদলীয় সভা ডেকেছিলেন, সেখান থেকে আওয়াজ তুলেছিল ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও।’ এখন কি তেমন পরিস্থিতি হলে আওয়ামী লীগ সে রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে? ডানের কথা বাদ দেই বাম দলও কি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? অভিজ্ঞতায় মনে হয় না। আর হয় না বলেই কেমন করে যেন সংখ্যালঘু নিপীড়ন ইস্যুটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হয়ে গেল, অতীতের মতো গণতান্ত্রিক-জাতীয়তাবাদী-অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর রইলো না। তবে দুশ্চিন্তা-রাগ-অভিমান-ক্ষোভ যা-ই থাকুক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শেষ ভরসার জায়গাটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেটা কমবেশি সবাই স্বীকার করে। এটাও সবাই স্বীকার করে, চাকরি-পদোন্নতি-পদায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ইতোমধ্যে হয়েছে।
এই পরিবর্তনকে অগ্রসর করে যদি আস্থা-বিশ্বাসের জায়গাটাকে দৃঢ় ভিত্তি দিতে হয়, তবে নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এর দুটো লক্ষ্য ও পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ সরকারের বাস্তবায়িত করা জরুরি। প্রথমটা হচ্ছে, ‘অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্ত্বাধিকারীদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।’ দ্বিতীয়টা হচ্ছে, ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন’ করা। প্রথমদিকে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও বিশেষ সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রিসভার প্রায় দুই বছর হতে চললেও তা হচ্ছে না কেন? আর স্বাধীনতা ৫০ বছর পরেও ভিন্ন নামে পাকিস্তানের শত্রুসম্পত্তির অবশেষ টিকে থাকে কেন? হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কেন জোরেসোরে কিংবা কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন কিংবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এই দুই ওয়াদা বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন না কেন? আইনি ন্যায্য অধিকারের জায়গাটাকে সুদৃঢ় না করে কি কেবল নিপীড়ন- বৈষম্য নিয়ে কথা বলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে! জানি না, কবে কখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ জাতীয় কবি নজরুলের ‘একই বৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু-মুসলমান’ জাতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আমরা হতে পারব।
তিন.
তৃতীয় ঘটনাটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক এবং মর্মমূলে আঘাত হানছে। ঘটনা মারদাঙ্গা সিনেমার মতো নাটকীয়তায় পূর্ণ। বাস্তবের ওই নাটকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অর্থ লুটপাটের পটভূমি আছে, অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা আছে, গোলাগুলি আছে, হাইজ্যাক আছে, ভয়াবহ ও শঙ্কা জাগানো সব ডায়লগ আছে, মামলা-পুলিশ আছে, সবশেষে আছে নায়কদ্বয়ের বিমান নিয়ে পলায়ন। দুটো বেসরকারি ব্যাংকের মালিক-পরিচালক ও কর্মকর্তারা কেউ কেউ হাচ্ছেন ওই থ্রিলিং নাটকের কুশীলব। সমাজের উপরি মহলের কদর্য ও ভয়ঙ্কর রূপ এতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। জাতির অর্থনৈতিক জীবনের এই ঘটনাটাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখা যাবে না। পঁচাত্তরের পর মানি ইজ নো প্রবলেম নীতির ভিত্তিতে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যে লুটেরা অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এমন ঘটনা ঘটেছে। যা আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাকে অনেটাই ধুলায় মিশিয়ে দেয়।
এই ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি যতটুকু খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার অর্ধাংশও যদি সত্য হয় তবে এক বিশেষ শ্রেণির (এর বাইরেও পুঁজিপতি রয়েছে) লুটেরা পুঁজিপতি ব্যাংক ও শিল্প মালিকদের অর্থ ও ক্ষমতার দৌরাত্ম কতটুকু হতে পারে, তার কয়েকটি দিক চোখে আঙুল দিয়ে সুস্পষ্ট করে দিয়ে গেল। এক. এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেখিয়ে দিচ্ছে নামে-বেনামে বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের কেউ কেউ জামানত ছাড়া ঋণ দিয়ে থাকেন। দুই. ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গুলি ছুড়তে, জিম্মি করতে, সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে অর্থ ও ক্ষমতা থাকলে কেউ পরোয়া করেন না। তিন. গুলি-জিম্মির ঘটনা ৭ মে থেকে ১৯ মে অর্থাৎ সুদীর্ঘ ১২ দিন ফেলে রাখা যায়। কেন বিলম্ব কে জানে। চার. নিজ মালিকানাধীন হাসপাতাল হলে মামলার আসামিরও নৈতিকতা ও রীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে রোগী হিসেবে সার্টিফিকেট দিতে কোনো অসুবিধা হয় না। পাঁচ. পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে হত্যা প্রচেষ্টা মামলার আসামিও পালিয়ে যেতে পারেন। ছয়. করোনাকালে রোগী না হয়েও আসামির পক্ষে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিদেশ যাওয়ার ছাড়পত্র নেওয়া এমন কঠিন কিছু না। এই ঘটনাকে যদি ইতোপূর্বের মাদক-ক্যাসিনো-নারী ব্যবসার সাথে মিলিয়ে কেউ দেখেন, তবে কি দোষ দেওয়া যাবে? বাংলাদেশ গুজব আর কানাঘুষার দেশ। কান পাতলে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত মতামত দেখলেই বুঝা যাবে, এই ঘটনা নিয়ে কতদিকে কত রকম গুজব ছড়াচ্ছে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আমরা আনুষ্ঠানিকতা ও আড়ম্বরের সাথে পালন করতে পারছি না। কিন্তু উল্লিখিত ধরনের ঘটনাগুলোকে তো অন্তত অবদমিত করে রাখতে পারতাম। করোনাকালে বা পরিসমাপ্তির পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে মানবতা ও আইনের শাসন তথা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি আরও কার্যকর হবে নাকি সমস্যা-সংকটের মধ্যে আইন লঙ্ঘন-অনৈতিকতা-অমানবিকতা আরও দুর্দমনীয় হয়ে উঠবে, কে জানে! মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী আমাদের আলোর পথ দেখাক, এটাই আজকের কামনা।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
এইচআর/বিএ