সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু সমাজসংস্কার, বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষায় তাঁর বিশাল ভূমিকা খুব একটা আলোচিত নয়। অথচ নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পথ দেখিয়েছিলেন। ছয় দফা আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়ার আগে আমেনা বেগমকে (১৯২৫-১৯৮৯) দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদে মনোনয়ন দেন বঙ্গবন্ধু। এই সময় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো প্রবীণ পুরুষ নেতা আপত্তি তুলেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ যেমন অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, তেমনি নরনারীর সমান অধিকারেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগেও নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার।”
Advertisement
বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রামী রাজনীতিতে নিজের সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকেও জড়িয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী থাকার সময় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সংকটে বেগম মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু ছেলেদেরই নয়, নিজের দুই মেয়েকেও পিতার আদর্শে, সামাজিক-সাংস্কৃতি-রাজনৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন বেগম মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী অধ্যক্ষ বদরুন্নেসা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অধ্যাপিকা নুরজাহান মোরশেদ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সরকারি চাকরি ও কর্মে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়াও সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট আনুপাতিক সংখ্যক পদ (১০ ভাগ কোটা) নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান অসমতায় নারীকে সহযোগিতার স্বীকৃতি দেয় সংবিধান যেখানে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অবদান রযেছে। জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য ৬৫ নম্বর ধারার মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাধারণ আসনের নির্বাচনেও নারীদের প্রতি করায় কোনো বাধা রাখা হয়নি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে সমাজের দুস্থ মানুষের পাশাপাশি বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের কথা সংরক্ষিত করা হয়েছে। একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক এবং বালিকার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। রাষ্ট্র কর্তৃক পতিতাবৃত্তি বন্ধ করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
Advertisement
বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ইতিহাস শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাঁদের দিয়েছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটি।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে এসে বীরাঙ্গনারা মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের বিশেষ স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির কলঙ্ক মোচনের আরেকটি ধাপ সম্পন্ন করেন নিজের স্বভাবজাত আন্তরিকতায়।
বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন বাংলাদেশ পুনর্বাসন বোর্ড। ঢাকার ধানমন্ডিতে যে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ছিল তা পরিচালনা করতেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তাঁদের জন্য আশ্রয় ও ভাতার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, নারীদের উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বৃত্তিপ্রথা চালুসহ নানাবিধ কাজ করার জন্য ঢাকার বেইলি রোডে চালু করা হয় সেক্রেটারিয়াল কোর্স, মোহাম্মদপুরে ব্যবস্থা করা হয় এবং সেলাই ও কারুশিল্প প্রশিক্ষণের, সাভারে খোলা হয় পোলট্রি ফার্ম।
পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের ফলে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গর্ভধারণ করা মায়েদের অনেকে গর্ভপাতের আশ্রয় নেন। তারপরও ১৯৭২ জুড়ে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য ১৯৭২ সালে Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 124 of 1972) জারি করা হয়।
Advertisement
বঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩ -১৯৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। কিন্তু ঘাতকের হাতে অকালে জীবন দিতে হওয়ায় তাঁর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থমকে দাঁড়ায়। ক্রমশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী শাসকদের হাতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে বাংলাদেশের নারীর উন্নয়নের রূপরেখা। ফলে নারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হবে কি না, নারীর সামর্থ্য রাষ্ট্র কতটুকু কাজে লাগাবে বা আদৌ লাগাবে কি না, নারীর অবস্থান পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটুকু নির্ধারিত করবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তা নিয়ে এক বিভ্রান্ত সমাজ গড়ে ওঠে ক্রমশ।
শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ছিল অপরিসীম। শিশু ও কিশোরীদের গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনকে ঢেলে সাজান এবং পুনর্গঠিত করেন। শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন ‘জাতীয় শিশু আইন’ (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারির মাধ্যমে শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের ‘জাতীয় শিশু দিবস’ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষের আয়োজনে। জাতি জাতির পিতার প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
মুজিব বর্ষে নারী-পুরুষ সমতাকে সুসংহত করার জন্য এবং দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী শিশুদের গড়ে তুলতে সবাইকে একযোগে কাজ করার মানসিকতা ধারণ করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারী ও শিশুর জন্য যে অবদান রেখেছিলেন, তাকে নির্দেশনা হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আদর্শ এক সমাজ গঠনের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)
এইচআর/বিএ/জেআইএম