সাহিত্য

ক্লাস পালানো ছেলেরা আসলেই মেধাবী হয়

মিজানুর রহমান মিথুন বহু গুণের অধিকারী। সব গুণের কথা বলে আজ আর সময় নষ্ট করবো না। তিনি একাধারে সাংবাদিক, গীতিকার, ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক। আজ কথা বলবো তার শিশুসাহিত্য নিয়ে। তিনি এক ডজনের অধিক শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে আজ কথা বলবো তার ‘ক্লাস পালানো ছেলে’ বইটি নিয়ে। ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলা থেকে সংগ্রহ করার পর দীর্ঘ লকডাউনে পড়ে ফেললাম বইটি। মোট নয়টি কিশোর ও শিশুতোষ গল্প রয়েছে এতে। সবগুলোই আমার কাছে কিশোর গল্প বলে মনে হয়েছে। যদিও দু’একটি গল্পের চরিত্রে শিশুর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি।

Advertisement

শুরুতেই ‘ক্লাস পালানো ছেলে’ গল্পে কায়সারের অঙ্কভীতির কথা জানতে পারলাম। কিন্তু গল্পে ক্লাস পালানোর মতো কোনো ঘটনা চোখে পড়েনি। বরং তাকে স্কুলে দেরি করে আসতে দেখা গেছে। গণিত ক্লাস তার ভালো লাগে না। বাংলা ক্লাস খুবই ভালো লাগে। তবে গল্পে কায়সারের ছবি আঁকাই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। ক্লাস পালিয়ে নয়; বরং ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সে ছবি আঁকে। ক্লাস পালানো আর ফাঁকি দেওয়া একই বিষয় নয়। আমরা ক্লাস পালিয়ে খেলতে বা সিনেমা দেখতে যেতাম। আর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে খাতায় ছবি আঁকতাম বা কবিতা লিখতাম। কায়সার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছবি এঁকে স্যারদের প্রশংসাও পেয়েছে। সুতরাং গল্পের নামকরণে আরও যত্নবান হওয়ার দরকার ছিল বলে মনে হয়।

শিশুতোষ গল্পে আমরা ‘পরি’ নামক কিছু একটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। যার আদৌ কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা আছে কি-না আমার জানা নেই। তবে জ্বিন জাতির কথা অবশ্যই স্বীকার করছি। তাই তো মিথুনের দ্বিতীয় গল্প ‘লালপরি ছাদে এসেছিল’ তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। গল্পটিতে মূলত শিক্ষণীয় বিষয়টি খুঁজে পাওয়া গেল না। যদিও জ্বিনের অস্তিত্বের কথা আমরা জানি। জ্বিনের স্ত্রী লিঙ্গকে আমরা পরি হিসেবে জানি। এও শুনেছি, পরি আসে পুরুষের কাছে। আর জ্বিন আসে নারীদের কাছে। মানুষকে ভয় দেখানো, বিভ্রান্ত করাই তাদের কাজ। গল্পে তাসফিয়ার কাছে পরি এসেছিল। যা অভিভাবকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করেছে। তাই আমার মনে হয়, এই পরি শিশু পাঠককেও ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পারে।

তৃতীয় গল্প ‘মায়ের ছবি’তে তিনজনের মৃত্যুর করুণ কাহিনি পাঠককে স্পর্শ করবে। তবে এই তিনজনের মৃত্যুই পাঠক হিসেবে আমার কাছে আরোপিত মনে হয়েছে। গল্পে অনিবার্যতা ছাড়া কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তাই মনে হলো, গল্পের প্রয়োজনেই তিনজনকে মরতে হলো। রফিকের মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাও মারা যান। বাংলাদেশে এই একটি যুক্তি খুবই শক্তিশালী। চাইলেই সিনেমা, নাটক, গল্পে আমরা যে কাউকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু এ ছাড়াও দুঃখ রয়েছে। রফিক যাদের কাছে পালিত হচ্ছে, তাদের ছেলেটিও জন্মের সপ্তাহখানেক পর মারা যায়। একে তো রফিকের কাছে মায়ের ছবি না থাকার দুঃখ, তার ওপর তিনজনের মৃত্যুশোক। কোমলমতি পাঠক কি এত দুঃখ নিতে পারবে?

Advertisement

চতুর্থ গল্প ‘রাহাত ও সাইকেলের গল্প’ পড়ে মনে হলো, মিথুনের গল্পের বেশিরভাগ প্রধান চরিত্র ‘সেভেনে’ পড়ে। তবে এ গল্পে লেখক নিজেও সন্দীহান রাহাতের শ্রেণি নিয়ে। ‘সিক্স কী সেভেন’ এমন হবে একটা কিছু। এছাড়াও কাহিনিতে সময় ও স্থানের ব্যাপারে দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেল। গ্রামাঞ্চলে ফুটবল খেলা হয় মূলত বিকেলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া রাহাত সেদিন কি স্কুলে যায়নি? আর বিপদে পড়লো বাবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনেই। তা-ও আবার এক শিক্ষকের ওপর সাইকেল উঠিয়ে দিয়ে। অন্তত এ জায়গাটিতে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হতো লেখক এবং তার গল্পের চরিত্রকে।

‘সেই ছেলেরা’ গল্পে লেখক দেশাত্মবোধ ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে এখানে তানজীলের বয়স বা শ্রেণি উল্লেখ করা হয়নি। তবে যে একেবারে শিশু নয়, তা অনুমান করা যায়। গল্পটিতে শিক্ষণীয় হলো, বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলা, তিতুমীরের প্রসঙ্গ। তাদের উপমা দিতে তুলে ধরা হয়েছে কুসুম কুমারী দাসের ‘সেই ছেলে’ কবিতাটি।

বইটিতে টোকাইদের নিয়ে গল্প রয়েছে ‘টিকলু টোকাই’ নামে। গল্পটিকে আনন্দ স্কুলের প্রচার মাধ্যমও বলা যায়। গল্পের মাধ্যমে টোকাইদের প্রতি বিত্তশালীদের মহানুভবতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘রাফির বিড়াল পোষা’ গল্পে পোষা প্রাণি সম্পর্কে বার্তা দেওয়া হয়েছে। তবে বিড়ালের প্রতি হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। নানা বাড়ি গিয়ে রাফি পোষা বিড়ালের প্রতি অমানবিক আচরণ করে। তবে লেখক একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন হয়তো, বিড়াল মেরে ফেললে দশ কেজি লবণ গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হয়।

‘পিতার ছবি’ গল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। গল্পটি পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এ গল্পে উঠে এসেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহতার দুঃসহ স্মৃতি। দেখতে পাই একজন চিত্রশিল্পীর দুঃখবোধ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার সীমাহীন ভালোবাসা পাঠককে আবেগাপ্লুত করবে।

Advertisement

‘বাঁশি’ গল্পটি পড়ে ঢাকা শহরের ফুটপাতের অসহায় দুটি শিশুর প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এক বিত্তশালী। তবে গল্পটি যতটা না শিশুতোষ, তার চেয়ে বেশি পরিণত মানুষের। তারপরও রাশি ও রিপনের প্রতি তাহের সাহেবের ভালোবাসা আমাদের উদার হতে শিক্ষা দেয়। মানবিক হয়ে ওঠার আহ্বান জানায়। তবে গল্পের সংলাপ নির্মাণে দুর্বলতা চোখে পড়েছে। কথ্য ও শুদ্ধ ভাষার সংমিশ্রণ শ্রবণকটু লেগেছে।

সবশেষে বলা যায়, প্রতিটি গল্পই সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। মানবিকতা জাগ্রত করে। ভালোবাসতে শেখায়। হাসতে শেখায়। কিন্তু গল্পগুলো আরও শক্তিশালী হতে পারতো। আমার মনে হয়েছে, গল্প নিয়ে বড্ড তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে মিথুনকে। কেননা মিথুন যেন দ্রুত লয়ে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। ফলে গল্পের পরিবেশ, প্রতিবেশ, আবহ, কাহিনি বিন্যাস, চরিত্রায়ন তেমন শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। অতিমাত্রায় দ্রুততা গল্পকে যেন নিষ্প্রাণ করে তুলেছে। আশা করি ভবিষ্যতে বিষয়গুলো তিনি খেয়াল রাখবেন।

আমার মনে হয়, গল্পের চরিত্র ও কাহিনি বিন্যাসে আরও বেশি নাটকীয়তা প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের গল্পে আরও বেশি শিশুতোষ মনন তুলে ধরতে হবে। তাহলেই মিথুনের বহুমুখী প্রতিভার সদ্ব্যবহার হবে বলে আশা করি। এ ছাড়া বানান ভুলের জন্য ঠিক কাকে দায়ী করবো বুঝতে পারছি না। অন্তত প্রতিটি পৃষ্ঠায় একাধিক বানান ভুল পাঠককে নিঃসন্দেহে বিভ্রান্ত করবে। যা লেখকের জন্যও বিব্রতকর। তবে আশার কথা হলো, বইটি বহুল পঠিত হবে। পাঠকের ভালোবাসা পাবে- এমন বিশ্বাস সহজেই করতে পারি।

বইয়ের নাম: ক্লাস পালানো ছেলেপ্রকাশনী: হুল্লোড়প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগরঅলঙ্করণ: অরূপ মন্ডলমূল্য: ১৩৫ টাকা

এসইউ/এমকেএইচ