জাতীয়

অকুতোভয় এক পুলিশ অফিসারের গল্প

১৮৬১ সালে বিধিবদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন সময় মানবতার ক্রান্তিলগ্নে এদেশের পুলিশ সদস্যরা হাসিমুখে সকল বিপদ-আপদ বুক পেতে নিয়েছে। বিপদের প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে হয় পুলিশকেই। এ কারণেই এদেশের জনগণ ভালোবেসে পুলিশকে বলে ‘ন্যাশনাল শক অব অ্যাবসর্বার’।

Advertisement

বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি করোনার আঘাতে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন বাংলাদেশ পুলিশ পড়ে ইতিহাসের কঠিনতম চ্যালেঞ্জে। একদিকে অদৃশ্য মরণঘাতী ভাইরাসের সাথে লড়াই, যাকে না দেখা যায়, না ছোঁয়া যায়। অপরদিকে আছে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রাণান্ত প্রয়াস। সবাই তখনই বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশ পুলিশকে এই চ্যালেঞ্জে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের সাড়ে চার হাজারের বেশি সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল এবং হাসপাতালের অধীনে বিভিন্ন রূপান্তরিত অস্থায়ী হাসপাতালে চিকৎসাধীন। এমনই এক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন ডিএমপির ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. বায়েজীদুর রহমান। করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সাথে ঈদ কাটানোর একটা পোস্ট ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এবং সাধারণের কাছে অকুতোভয় পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় সার্বিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ পুলিশ সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সন্তান যখন নিজের পিতা-মাতাকে পরিত্যাগ করছে, স্ত্রী পালিয়ে যাচ্ছে স্বামীকে ছেড়ে, পরিবার যখন আপনজনের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে পুলিশ কিন্তু সেখানে এগিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে যেয়ে পুলিশ কিন্তু কোনো বাছবিচার করতে পারছে না- কে করোনা আক্রান্ত, আর কে সুস্থ। পেশাদারিত্বের সাথে মানবিকতার যোগে তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব পুলিশিং।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘কী করছে না পুলিশ। ব্যক্তি উদ্যোগে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা, করোনা আক্রান্ত মৃতব্যক্তির দাফন, গর্ভবতী নারীদের নিরাপদে হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া, জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির নানা আয়োজনসহ পুলিশের রুটিন কার্যক্রম। কোথায় নেই বাংলাদেশ পুলিশ!’

‘অন্য চাকরিতে ইচ্ছা করলে জনসমাগম এড়িয়ে চলা সম্ভব, কিন্তু পুলিশের কাজই তো জনগণকে সাথে নিয়ে। এখানে জনগণকে এড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার সুযোগ খুবই সীমিত। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ অতীতের মতো এবারও ক্রান্তিলগ্নে কীভাবে নিজের জীবন বাজি রেখে লড়তে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছে। জয় করে নিয়েছে এদেশের জনগণের মন। দৃষ্টান্ত তৈরি করে রেখে দিল অন্যদের জন্য।’

মো. বায়েজীদুর রহমান বলেন, ‘আইজিপি স্যারের নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এত বিপুল সংখক পুলিশ সদস্যকে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব নয় বিধায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইজিপি স্যারের একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে দ্রুততম সময়ে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভাড়া নিয়ে সেখানেও আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও পুলিশ হাসপাতাল সংলগ্ন দুইটি ব্যারাক স্বল্পতম সময়ে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে যেখানে একত্রে ৭০০ রোগীর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’

‘এখানে সর্বোচ্চমান বজায় রেখে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে বিধায় দ্রুত রোগীরা সুস্থ হয়ে পুনরায় নবউদ্যমে কাজে যোগদান করে দেশসেবায় নিয়োজিত করছেন। প্রতিনিয়ত রোগীরা সুস্থ হয়ে চলে যাচ্ছেন কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বমুখী আক্রান্তের হারের কারণে আবার নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আইজিপি স্যারের নির্দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্তসমূহ প্রতিপালন সাপেক্ষে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার এবং নার্স ট্রাফিক ব্যারাকে অবস্থান করে তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়। পুলিশ হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে সকল ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশলাইন্স থেকে তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।’

Advertisement

ভাইরাল হওয়া তার ফেসবুক পোস্টের ব্যাপারে তিনি এই বলেন, ‘আসলে ভাইরাল হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে তো ফেসবুকে কোনো পোস্ট করিনি। ঈদ এদেশের মানুষের সর্ববৃহৎ উৎসব। বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ঈদের আনন্দে মেতে ওঠে। এবারের ঈদ অন্য ঈদগুলো থেকে একেবারেই ভিন্ন। ট্রাফিক ব্যারাকে করোনা আক্রান্ত যারা ভর্তি আছেন, তাদের এবং তাদের আপনজনের জন্য এবারের ঈদ ছিল চরম উৎকণ্ঠায় ভরা। বাংলাদেশ পুলিশ দুই লাখের অধিক সদস্যের একটা পরিবার। রাষ্ট্রীয় কাজে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের পক্ষে প্রায় কখনোই নিজের আপনজনের সাথে ঈদ কাটানোর সুযোগ হয়ে ওঠে না। আবার আমরা যে পরিবার ছাড়া ঈদ পালন করি তেমনটা কিন্তু না, আগেই বলেছি বাংলাদেশ পুলিশ একটা পরিবারের নাম। ভাবলাম ব্যারাকে এই মুহূর্তে আমার প্রায় ৭০০ পরিবারের সদস্য রয়েছে, তাদের সাথেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করি, এতে করে তাদের মনোবলও চাঙ্গা হবে, ঈদের আনন্দটাও বেড়ে যাবে। তেমন চিন্তা থেকেই এবারের ঈদের দিনটা করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সাথে কাটিয়েছি। আমি যে শুধু ঈদের দিন কাটিয়েছি, তেমনটা কিন্তু না, আমার প্রতিদিনই কাটে এসব সদস্যের সাথে। শুধু ঈদের দিন বলেই ফেসবুক পোস্ট করেছিলাম এবং সাধারণ জনগণ পোস্টটি পছন্দ করেছে।’

সাধারণ জনগণের উদ্দেশে এই সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘করোনা ছোঁয়াচে মহামারি। বিনা কারণে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের এবং পরিবারের বিপদ ডেকে আনবেন না। অল্প কিছু মানুষের অবিবেচক আচরণের কারণে আজ পুলিশের এত সদস্য করোনা আক্রান্ত। জরুরি কাজে বের হওয়ার আগে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে বের হবেন। ভিড় এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করবেন। অন্য মানুষের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকে কাজ সেরে ফেলার চেষ্টা করুন। কোনো অবস্থায় নাকে বা মুখে হাত দেবেন না। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে থুথু ফেলবেন না। সরকার ঘোষিত সকল নির্দেশনা মেনে চলুন। নিজে সুস্থ থাকুন, অপরকে নিরাপদে রাখুন।’

এআর/বিএ/জেআইএম