অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান
Advertisement
২০১৯ এর ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহর থেকে উৎপত্তি হয়ে আজ অবধি বিশ্বব্যাপী তছনছ করে চলেছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অদৃশ্য অণুজীব যার নাম করোনাভাইরাস। ইতোমধ্যে ২১৩টি দেশ-অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এ সকল দেশে সকল রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হচ্ছে করোনাভাইরাসের গতিবিধির ওপর নির্ভর করে। এ ভাইরাস ৩০ মে পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে ৩,৬৬,৮৯৬ জন মানুষের তাজা প্রাণ আর আক্রান্ত করেছে ৬০,৩৪,৬৬৬ জনকে। ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে সংক্রমণ আর মৃত্যর মিছিল, ধ্বংস করে চলেছে সভ্যতা, অর্থনীতি, জনজীবন। কঠিনভাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বিজ্ঞানকে। বিশেষ করে চিকিত্সা বিজ্ঞানকে।
আজও আবিষ্কৃত হয়নি কোনো ওষুধ, হয়নি ভ্যাকসিন- কোনোক্রমেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না ভাইরাসটিকে, ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যু। মুমূর্ষু রোগীর জন্য পরীক্ষণ ( ট্রায়াল) চলছে রেমডেসিভির ওষুধের আর প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের। ক্লোরোকুইন ব্যবহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেক দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধই কার্যকর হয়, অন্য কিছু নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ভ্যাকসিন তৈরির প্রার্থী ১১৪টি। এর মধ্যে ১০টি এগিয়ে আছে- যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি, চীনের ৫টি, যুক্তরাজ্যের ১টি যারা পরীক্ষার ২য় পর্যায়ে আছে। পাশের দেশ ভারতও পিছিয়ে নেই। চলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পরস্পরবিরোধী সংবাদের প্রতিযোগিতা, রয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা।
এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় কোনো নিরাপদ বা কার্যকর ওষুধ পাওয়া যায়নি। গবেষকরা আশা করছেন, কনভালেসেন্ট প্লাজমা মুমূর্ষু কোভিড রোগীর শরীরে সঞ্চালন করলে তার ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এভাবে রোগীদের উপকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোভিড-১৯ জরুরি জনস্বাস্থ্য চলাকালীন সেবা প্রদানকারী এবং গবেষকদের জন্য কোভিড-১৯ কনভালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহার এবং পরীক্ষা করার জন্য একটি নির্দেশনা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত এফডিএ কোভিড-১৯ কনভালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহারের কোনো অনুমতি দেয়নি। এফডিএ কনভালেসেন্ট প্লাজমা সংগ্রহ এবং ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করে না।
এফডিএ বলেছে, "Although promising, convalescent plasma has not been shown to be safe and effective as a treatment for COVID-19. Therefore, it is important to study the safety and efficacy of COVID-19 convalescent plasma in clinical trials." এ কারণে বর্তমানে এটিকে বলা হয়, জরুরি পরীক্ষণমূলক নতুন ওষুধ (eIND)। যুক্তরাষ্ট্রের যে সমস্ত চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠান আইএনডিতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী তাদের একটি নির্দিষ্ট ফরমে এফডিএর অনুমতি নিতে হয়।
রোগীর উপযুক্ততা১. ল্যাবরেটরিতে নিশ্চিত কোভিড-১৯ আক্রান্ত২. মারাত্মক অথবা জীবন হুমকির সম্মুখীনমারাত্মক বলতে বুঝায়- শ্বাসকষ্ট, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে ৩০ বারের বেশি, রক্তে অক্সিজেনের সম্পৃক্ততা শতকরা ৯৩ ভাগের কম, ফুসফুসের অকার্যকারিতা ২৪-৪৮ ঘণ্টায় ৫০ ভাগের বেশি। জীবন হুমকির সম্মুখীন বলতে বুঝায়- শ্বাস-প্রশ্বাস অকার্যকর, সেপটিক শক, শরীরের একাধিক জরুরি অঙ্গ অকার্যকর।
প্লাজমা প্রদানের উপযুক্ততা :১. রক্তদানের সকল সাধারণ যোগ্যতা থাকতে হবে২. রক্তবাহিত সংক্রামক রোগের পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে৩. ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ শনাক্ত পরীক্ষা নিশ্চিত থাকতে হবে৪. রক্তদানের অন্ততপক্ষে ১৪ দিন আগে সম্পূর্ণভাবে উপসর্গ মুক্ত হতে হবে৫. একান্ত জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ দেখে নিতে হবে। জরুরি ক্ষেত্রেও পরে দেখে নিতে হবে।প্লাজমা (রক্তরস)- এটি হাল্কা হলুদাভ তরল যা সাধারণত দেহের বিভিন্ন প্রকার রক্তকোষ ধারণ করে। মানবদেহের রক্তের প্রায় শতকরা ৫৫ ভাগ হচ্ছে প্লাজমা। এর ৯৫ শতাংশ হচ্ছে পানি এবং ৬-৮ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন প্রোটিন, গ্লুকোজ, রক্তজমাট বাঁধার উপাদান, ইলেক্ট্রোলাইটস, হরমোন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও অক্সিজেন।
Advertisement
কনভালেসেন্ট প্লাজমা
মানবদেহে যখন কোনো জীবাণু প্রবেশ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের রোগ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং প্রস্তুত হয় অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডি শরীরে রোগজীবাণুকে প্রতিরোধ করে, ধ্বংস করে এবং প্রত্যাহার করে। একজন আক্রান্ত রোগী সুস্থ হলে তার শরীরের প্লাজমাকে কনভালেসেন্ট প্লাজমা বলা হয় যার মধ্যে উক্ত জীবাণুর নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি থাকে। এই প্লাজমা যদি একই জীবাণুতে আক্রান্ত অন্য রোগীর দেহে সঞ্চালিত করা হয় তাহলে একইভাবে উক্ত রোগীর শরীরেও এই অ্যান্টিবডি রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এর আগেও ১৯১৮ সালে স্পেনিশ ফ্লুতে, পরবর্তীতে সার্স, ইবোলো, এইচওয়ান এনওয়ানসহ বিভিন্ন রোগে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হয়েছে।
২০২০ এর ফেব্রুয়ারি মাসেই চীনের চিকিত্সকরা মুমূর্ষু কোভিড রোগীদের প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে যা ওই সময়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে কার্যকর এবং জীবনরক্ষাকারী বলে মন্তব্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সরকার মুমূর্ষু কোভিড রোগীর জন্য প্লাজমা থেরাপি ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে। গত ৮ মে ভারতের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (আইসিএমআর) ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই প্লাজমা থেরাপির ট্রায়াল চলছে।
বাংলাদেশ সরকার প্লাজমা থেরাপি ট্রায়ালের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে দিয়েছে । কমিটি ইতোমধ্যে প্রস্তুতিমূলক অনেক কাজ করেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগও করেছে। এছাড়া বিছিন্নভাবে বিভিন্ন হাসপাতাল প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করছে । মনে রাখতে হবে প্লাজমা থেরাপি মুমূর্ষু কোভিড রোগীদের জন্য একটি পরীক্ষণমূলক (ট্রায়াল) ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয়ভাবে এর একটি নিয়ন্ত্রণ থাকতেই হবে। প্রধানত এটি রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের দায়িত্ব । বাংলাদেশে গর্ব করার মতো দেশব্যাপী রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, কর্ম পরিকল্পনা এবং নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ বিভাগের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সমন্বয়ের মাধ্যমে প্লাজমা থেরাপির ট্রায়ালের কাজটি হতে হবে।
সুপারিশসমূহ
১. দ্রুত টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সমন্বয় স্থাপন করতে হবে।২. গণমাধ্যমের মাধ্যমে উপযুক্ত ডোনারের মোটিভেশনের জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।৩. প্লাজমা প্রয়োগের আগে অ্যান্টিবডির পরিমাণ (টাইটার) দেখতে হবে। জরুরি ক্ষেত্রে না পারলে পরে দেখে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে সব রোগীর ক্ষেত্রে যথাযথ অ্যান্টিবডি প্রস্তুত নাও হতে পারে।৪. মোটিভেশন এবং প্লাজমা সংগ্রহের জন্য সন্ধানীর সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।৫. টেকনিক্যাল কমিটিকে অবহিত করেই সকল হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশেও সংক্রমণের হার বেড়ে চলেছে, প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন মৃত্যুতালিকা। সরকারকে জীবন-জীবিকা দুটো বিষয় নিয়েই ভাবতে হয়, দায়িত্ব নিতে হয়। ১ জুন থেকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই খুলেছে অফিস-আদালত, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এ ভয়ংকর মহামারি সামাল দেয়া বাস্তব নয়। নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরকেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করি।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ।
এইচআর/বিএ/জেআইএম