গ্রামের অনেকেই ভাগ্য বদলের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। তাদের স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। তাদের দেখাদেখি বকুল হোসেন গত বছর লিবিয়া যান। সেখানে ভালোই ছিলেন। কাজ করছিলেন, বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছিলেন। পরিবারে আসতে শুরু করেছিল আর্থিক সচ্ছলতা। এর মাঝেই গত বৃহস্পতিবার ঘটে যায় দুর্ঘটনা।
Advertisement
দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হয়ে ত্রিপলির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বকুল হোসেন। বর্তমানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
গতকাল শুক্রবার জাগো নিউজকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, লিবিয়ায় এক মানবপাচারকারীর স্বজনদের হাতে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন অভিবাসী খুন হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও ১১ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে ছয়জন এখন শঙ্কামুক্ত। তবে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর। এই পাঁচজনের মধ্যে দুজনের অপারেশন হয়েছে। বাকি তিনজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
নির্মম ওই ঘটনায় জড়িত মানবপাচারকারী চক্রকে দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। সন্তান হারানোর বেদনায় কান্নার রোল পড়েছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের ইসরাইল হোসেনের ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিবের (২০) বাড়িতে। এছাড়া লিবিয়ায় গুলি করে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় মাদারীপুরের ১৩ যুবকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন নিখোঁজ যুবকদের পরিবার।
Advertisement
দেশটিতে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা জানান, নিহত ২৬ বাংলাদেশির মরদেহ সেখানকার মিজদাহ শহরে কবর দেয়া হয়েছে।
গুরুতর আহতদের মধ্যে বকুল হোসেন (২৫) অন্যতম। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদা ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের বাজার পাড়ার দিনমজুর হাসান আলীর ছোট ছেলে।
বকুল হোসেনের মা মোমেনা খাতুন বলেন, ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বকুল হোসেন স্থানীয় দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে ঢাকা যায়। কয়েক দিন ঢাকায় থাকার পর লিবিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
গ্রামের অনেকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন বিদেশ গিয়ে, এটা দেখে বকুলের বিদেশ যাওয়ার আগ্রাহ তৈরি হয়। তারা টাকা উপার্জন করছেন, বাড়ি তৈরি ও গ্রামে জমি কিনছেন। তাদের দেখাদেখি উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়েই বিদেশ যায় সে। দরিদ্র পিতার কষ্ট লাঘব করতেই বিদেশ যাওয়া। লিবিয়া গিয়ে বেশ ভালোই ছিল বকুল।
Advertisement
তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে লিবিয়া যাওয়ার জন্য দালালের সঙ্গে চুক্তি করেন বকুল হোসেন। সঙ্গে লিবিয়ায় যান তার এক মামাতো ভাই, এক ফুপাতো ভাই এবং এক খালাতো ভাই। ফরিদপুর জেলার দালাল বক্কর সরদারের মাধ্যমে লিবিয়া যান তারা। সেখানে যাওয়ার পর উপার্জনের টাকাও বাড়িতে পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে টাকা জমিয়ে ইউরোপের দেশ ইতালিতে যাওয়ারও স্বপ্ন ছিল বকুলের। চেষ্টাও করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ইতালিতে যাওয়ার পথে অপহরণকারী করে একটি চক্রের হাতে পড়েন।
ওই চক্রটি তাদের একটি ঘরে আটকে রেখে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করে। দাবিকৃত মুক্তিপণের টাকা না দেয়ায় সেখানে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালালে ২৬ বাংলাদেশি মারা যান এবং আহত হন ১১ জন। আহতদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার বকুলও রয়েছেন।
বকুলের মা আরও জানান, গত ২৮ মে (বৃহস্পতিবার) রাতে বকুল লিবিয়া থেকে বাড়িতে মোবাইল ফোনে কথা বলে। সে বলে, মা আমরা ভালো নেই। অপহরণের পর আমাদের একটি ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। আমি যেন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হতে পারি, সে দোয়া করো। এর বেশি মায়ের সাথে আর কথা হয়নি বকুলের।
গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় লিবিয়ার ত্রিপলির একটি হাসপাতালে অন্যদের সাথে সেও চিকিৎসাধীন। ছেলের আহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর মায়ের কান্নায় গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ছেলের কথা বলতে বলতে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন মা মোমেনা খাতুন। তিনি চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘ফিরে আই বাজান, আমার নাড়িছেঁড়া ধনরে’।
আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দারুস সালাম বলেন, কয়েক মাস আগে বকুল দালালের মাধ্যমে বিদেশ যায়। বিদেশ যাওয়ার আগে মাকে বলে টাকা দেয়ার সময় চেয়ারম্যানকে জানাতে। লিবিয়া পৌঁছানোর পর তার মা চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে দালালের ব্যাংক হিসাবে টাকা দেন।
আলমডাঙ্গা থানার ওসি আলমগীর কবির জানান, লিবিয়ায় আহত যুবকের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়েছি। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সালাউদ্দীন কাজল/এমএআর/জেআইএম