করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ইউরোপের দেশগুলোতে যে মৃত্যুর হিমশীতল প্রবাহ বয়ে গেছে, গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে, তা কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এ প্রবাহ কিছুটা ধীর বেগে ছুটে চলেছে ঠিকই, কিন্তু যেকোনো সময় আবারও আঘাত হানা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। ইতালিতে প্রাত্যহিক মৃত্যু কমেছে। হ্রাস হয়েছে স্পেনেও। ব্রিটেনেও আছে শ্লথগতি। দিনের হিসাবে ব্রিটেনে হাজারের কাছাকাছিও গেছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা। সময়ের পরিক্রমায় এ হার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, এটা বলতেই হয়। কিন্তু মৃত্যুর মিছিলের সম্মুখে এখনও ভিড় করে আছে প্রতিদিন শত শত মৃত্যু, বিশেষত ব্রিটেনে। এ সপ্তাহে মৃত্যু হ্রাস পেয়েছিল দুদিন, কিন্তু আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না।
Advertisement
তবুও ব্রিটেনে নেই সেই নীরবতা। পানশালা খোলেনি, রেস্টুরেন্টে নেই খাবার সার্ভিস। কিন্তু মানুষ যেন থেমে থাকতে চাইছে না। রাস্তাঘাটে আছে যানবাহনের শো শো আওয়াজ। সরকার নির্ধারিত লকডাউনের বিপরীতে দাাঁড়িয়েছে কতিপয় মানুষ। পার্ক মুখরিত করছে। পাবে-ক্লাবে নাচতে নাচতে মাতালামোটা বাড়িয়ে দিতে কেন জানি উদগ্রীব হয়ে আছে মানুষ।
পৃথিবীর সব জায়গায়ই উগ্র মানসিকতার মানুষ আছে। ব্রিটেনেও যে নেই তা নয়। করোনায় যখন দেশটি বিপর্যস্ত, অর্থনীতির একটা বড় ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে পশ্চিমের অনেকে দেশগুলোর মতো এ দেশটিরও। বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন পাউন্ডের অফেরতযোগ্য অনুদান দেয়া হয়েছে ছোট থেকে বড় ব্যবসা প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে, এছাড়াও স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে হাজারো লাখো পাউন্ড। ইতোমধ্যে বড় ধরনের রিসেশন বা মন্দায় পড়ার ঈঙ্গিত দিয়েছেন ব্রিটেনের চ্যান্সেলার।
কিন্তু এটা সত্যি, দমবন্ধ হযে যাচ্ছে মানুষের নিত্যদিন। বিশেষত বয়স্ক মানুষদের একটা বিশাল অংশ বাস করে একাকী। এদের নিঃসঙ্গ জীবনে পাবই তাদের সামাজিক যোগাযোগের কিংবা গল্পগুজব করার একমাত্র জায়গা। মাসের পর মাস এই মানুষগুলো হয়ে পড়েছে আরও নিঃসঙ্গ। এই মানুষগুলো পার করছে চরম দুঃসহ সময়। কেয়ারহোমের পড়ে থাকা প্রবীণদের মাঝে সীমাহীন শঙ্কা, কারণ এই করোনায় তাদের মৃত্যুটা সারা পশ্চিমা দেশগুলোতে ভীতির সঞ্চার করেছে। তারা অরও বেশি উদ্বিগ্ন কারণ তাদের মৃত্যুর পাশাপাশি কেয়ারারদের মৃত্যুর সংখ্যাটাও কম নয়। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাঘাত ঘঠছে প্রবীণদের দেখাশোনায়ও।
Advertisement
কিন্তু চরম দুঃসহ সময় মানে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ নয়। করোনা মানে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ। দুঃসহ সময় পাড়ি দেয়া যায়, কিন্তু মৃত্যুতো একটা জীবন ছিনিয়ে নেয়, মৃত্যু মানে একজন মানুষের জীবনের শেষপাঠ। একটা পরিবারের দুঃসহ সময়। একজন মানুষের শেষ ঠিকানা, যেখান থেকে আর ফিরে আসে না কেউ। আর সে কারণেই স্বেচ্ছায় মৃত্যু চায় না কোনো সুস্থ মানুষই। কিন্তু ব্রিটেন এমন অবস্থায় চলে যাচ্ছে, যেখানে স্বেচ্ছায় যেন মৃত্যু চাইছে কিছু মানুষ। এই মৃত্যু দিয়ে তারা গোটা জাতিকেই দাঁড় করাতে চাইছে কাটগড়ায়। কারণ তাদের চাওয়ায় তারা যদি পেয়ে যায় অবারিত সুযোগ, তাহলে গোটা পৃথিবীর কাছেই দেশটা হয়ে যাবে প্রশ্নবোধক। সরকারের এত প্রণোদনা, নাগরিকদের সুরক্ষা, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার সরকারের প্রাণপণ চেষ্টা সবকিছুই প্রশ্নবোধক হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লকডাউনের শিথিলের একটা ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনিও সাহস করে সে শিথিল অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেননি। একটা আতঙ্ক আছেই। গত কয়েক মাসে ৩৭ হাজার ৪৬০ জন মানুষের মৃত্যুর তুলনায় ২৬ মে ছিল সর্বনিম্ন ১৩৫। এ এক আশার কথা যদিও। কিন্তু এর পরদিন অর্থাৎ বুধবারই ৪০০'র উপরে উঠেছে এ মৃত্যু। কিন্তু তবুও মানুষ দলবেঁধে নামছে। এশিয়ান গ্রোসারিগুলোতে (ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি) ভিড় করছে মানুষ। অথচ এই দোকানগুলো থেকে ব্যাপক সংক্রমণের কথা বলে থাকেন অনেকেই।
কমিউনিটির অনেক প্রিয়জন আমরা হারিয়েছি এই সময়ে। ব্রিটেনের মানুষগুলোর একটা অংশ (ছোট হলেও) পার্কে গিয়ে লকডাউনের বিরুদ্ধে রীতিেতো প্রতিবাদী হয়েছে। প্লেকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে লন্ডনের হাইড পার্কে বিক্ষোভ করেছে। এই বিক্ষোভে বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণ-তরুণীরাও সাথে ছিল। ম্যানচেস্টারে একইভাবে প্লাটফিল্ড পার্কে জমায়েত হয়েছে কিছু মানুষ। এদের একটা বড় অংশই হাস্যকর সব যুক্তি উত্থাপন করছে করোনা প্যান্ডেমিকের বিরুদ্ধে। এমনকি তাদের কেউ কেউ প্লেকার্ডে লিখেছে করোনা ‘ফেক ভাইরাস’। প্লেকার্ডগুলো উঁচিয়ে ধরে বাজে ধরনের ঈঙ্গিত দিয়ে ছবি পোজ দিয়েছে, যখন সাংবাদিক ছবি তুলেছেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষোভ দেখানোর দায়ে কয়েকজনকে হাইড পার্ক থেকে আটক করেছিল পুলিশ। এমনকি হাতকড়া পরিয়েছে অনেককে। এতে লেবার পার্টির সাবেক লিডারের এক ভাইও ছিলেন। সমুদ্রবিলাসে বেরিয়েছে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে। লকডাউন শিথিলের ঈঙ্গিত থাকলেও বিভিন্ন শহর থেকে ছুটে আসা সমুদ্রবিলাসীরা আশাহত হচ্ছেন। কারণ কিছু কিছু কাউন্সিল তাদের নিজস্ব ক্ষমতাবলে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করতে সমুদ্রতীর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এনেছে। এমনকি ব্রিটেনের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করা ব্লাকপুল সমুদ্রসৈকতে আসতে নিষেধ করা হয়েছে।
Advertisement
এবং এটাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ ব্রিটেন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিপূর্ণ সময় পেরিয়ে এসেছে যদিও, কিন্তু জনগণ নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চললে কিংবা অবজ্ঞা করলে, সাবধানতা অবলম্বন না করলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া ব্রিটেনে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান হলো, ‘প্রটেক্ট দ্য এনইচএস’। এনইচএস অর্থাৎ জাতীয় সেবা খাতকে বাঁচাতে আগের স্লোগানে যুক্ত ছিল ছিল ‘স্টে হোম’। এখন সামান্য পরিবর্তন হলেও নতুন স্লোগানটিও সেই একই অর্থবোধক। যেখানে বলা হচ্ছে ‘স্টে অ্যালার্ট’।
কিন্তু এনএইচএস ‘প্রটেক্ট’ এর ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। করোনার প্রাথমিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের জাতীয় স্লোগান ‘স্টে হোম, প্রটেক্ট দ্য এনইচএস, সেভ লাইভস’ এর জায়গায় ব্রিটেনের বর্তমান বাস্তবতায় নতুন স্লোগান হলো ‘স্টে অ্যালার্ট কন্ট্রল দ্য ভাইরাস, সেভ লাইভস’। অর্থাৎ সতর্ক থাকতেই হবে, নিজেকে এবং অন্যকে বাঁচাতে। কোনোভাবেই সে জায়গায় যারাই অ্যালার্ট কিংবা সতর্ক না হয়ে বেপরোয়া জীবনচারী হয়ে যাবে, তারা প্রকারান্তরে এনএইচএসের লাখো কর্মীদের অসম্মান করবে। তথা জাতিকেই অপমান করা হবে।
কিছু মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই বেপরোয়া। তাদের বেপোরায়া কিংবা গোয়ার্তুমি তাদের নিজেদের জন্য যতটুকু ক্ষতির কারণ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে গোটা জাতির জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোটা জাতিকেই এর জন্য মাশুল গুনতে হয়। এ মাশুল এমন হয়ে যায় যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোটা জাতিকে অপমানিত বোধও করতে হয়। জাতিকে এ রকম অপমান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ম্যানচেস্টারের অসংখ্য মানুষ। স্থানীয় ম্যানচেস্টার ইভিনিং নিউজ পত্রিকায় সাধারণ মানুষের এই আবেগের কথাই উঠে এসেছে। তারা বলেছেন, প্লাটফিল্ড পার্কে বিচ্ছিরি ধরনের ছবি প্রদর্শন করে তারা দেশটার নাগরিকদেরই অপমান করছে।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই এ ভাইরাস আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এ এক উদ্বিগ্নতা। সন্তানের জন্য পিতামাতার, অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের। ভাইয়ের জন্য বোনের, বোনের জন্য ভাইয়ের। স্বজন-পড়শী একে অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন নিজের জন্য। এ উদ্বিগ্নতা থেকে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে অন্তত আরও কটা দিন অপেক্ষায় থাকাটাই ছিল হয়তো যৌক্তিক। আর সে জন্য থাকতেই হবে অ্যালার্ট।
এইচআর/বিএ/এমএস