দেশজুড়ে

লবণাক্ততার করাল গ্রাসে রামপালের সবুজ প্রকৃতি

`লবণে গাছপালা মইরে সব শেষ। সুবরী (সুপারি) কিনো তো খাতি হবেই। এখন কি আর আগের সেই দিন আছে` রামপালের ইসলামাবাদ গ্রামের বৃদ্ধা মো.আমিন উদ্দিনের এ কথার প্রমাণ খুঁজতে বেশি দেরি হলো না। এ উপজেলার শ্রীফলতলা, বশতলী, কুমলাই, ফয়লা, গিলাতলা গ্রামের অসংখ্য মানুষের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে রামপাল এলাকার এক সময়ের অতি পরিচিত এই রাজমিস্ত্রীর কথায়।৭০ দশকের সেই সবুজ প্রকৃতির কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই রামপালে। এই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শ্রীফলতলা গ্রামের যে দিকে চোখ যায় এখন শুধু নোনা জল আর জল। জলের মধ্যে দ্বীপের মতো বসতবাড়ির ভিটায় কিছু গাছের ফাঁকে উঁকি মারছে হাতে গোনা কয়েকটি নারকেল-সুপারি আর তালের গাছ। যেন জলের মধ্যে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই। পাখ-পাখালির কলতান নেই কোথাও।ফারাক্কা বাঁধের কারণে উজানে পানি প্রবাহ এখন আর বঙ্গোপসাগর উপকূলে পৌঁছায় না। সাগরের নোনা জল ক্রমশ উত্তরে দিকে এগিয়ে চলছে। সেই সঙ্গে দিনে দিনে বেড়ে চলছে লবণাক্ততার পরিমাণ। লবণাক্ততার করাল গ্রাসে বিপন্ন হতে চলেছে দক্ষিণের সবুজ প্রকৃতি। তাল, নারকেল, সুপারির মতো ফলদ বৃক্ষের সমারোহ আর ছোখে পড়ে না এখানকার কোনো বাড়িতেই। এক একটি বাড়ি যেন বিরানভূমি। উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের অধিকাংশের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে পরিবেশ। পরিবেশ বিপর্যয়ের চরম প্রভাবে এখানকার হাজার হাজার পরিবারের জীবনযাত্রা থমকে যেতে বসেছে।ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে এ অঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে প্রকৃতিতে তার প্রভাব পড়ার ফলে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ৮০ দশকের শুরুতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে গুটি কয়েক ব্যক্তি নদী খালের নোনা পানি আটকে শুরু করে বাগদা চিংড়ি চাষ। চিংড়ি চাষের প্রবণতা দিনের পর দিন বাড়তে থাকায় এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিক গতিধারায় আনে ছন্দ পতন। শুরু হয় অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ। সঙ্গে বাড়তে থাকে খাল বিল দখলের প্রতিযোগিতা।রামপালের শ্রীফলতলা গ্রামের মধ্য বয়সী শেখ খায়রুল বাশারের (৩৭) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ৪টি নারকেল গাছের একটিতেও ফল নেই। গাছগুলো সরু হতে হতে মরার উপক্রম। পুকুর পাড়ে দুই যুগ আগের লাগানো তাল আর খেঁজুর গাছের করুণ চিত্র। বৃদ্ধ বাবা শেখ আব্দুর রহমান (৭২), মা আর ছোট ভাই রফিকুলকে (২৫) নিয়ে বাশারের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ২২ বছর আগে শ্রীফলতলার ২ বিঘা বসতবাড়ির প্রায় ১ বিঘা জমিতে চিংড়ি খামারের মধ্য দিয়েই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে বাশার সংগ্রাম শুরু করে।প্রথম দিকে মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় লেখাপড়া না শিখে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। এখন ২৫ বছরের যুবক ছোট ভাই তার কাজের সহকর্মী। কিন্ত আগের সে দিন আর নেই। বসত ভিটা আর পুকুর পাড়ে লাগানো ৬০টি নারকেল গাছের এখন অবশিষ্ট রয়েছে ৪টি। শতাধিক সুপারি গাছের একটিও বেঁচে নেই। পুকুর পাড়ে লাগানো ২০টি তাল গাছের মধ্যে বেঁচে রয়েছে ৩টি।বাশার জানায়, বৃদ্ধ বাবা -মা আর ছোট ভাইয়ের দেখাশোনার ভার তার উপর। নারকেল, সুপারি গাছ মরে যাওয়ায় বাড়তি আয় বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। গত তিন বছর ধরে চিংড়ি চাষে লাভ হচ্ছে না, ভাইরাস লেগে মরে যাচ্ছে মাছ। ঘেরে সাদা মাছ, রুই কাতলার চাষ করে কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তিনি। আগামী দিনগুলোতে কিভাবে পথ চলবে তা নিয়ে চরম হতাশা বাশারের চোখে মুখে।ইসলামাবাদ গ্রামের পাকা রাস্তায় উঠতে গিয়ে কথা হয় এই গ্রামের বৃদ্ধা মো. আমিন উদ্দিনের সঙ্গে। স্ত্রী ফাতেমা আর দুই ছেলে মোহাম্মদ আলী (৫০) ও আল আমীনকে (২১) নিয়ে তার পরিবার। বড় ছেলে সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। ছোট ছেলে বাবার রেখে যাওয়া পেশা রাজমিস্ত্রির কাজ আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে চলছে। হতাশার ছাপ বৃদ্ধা আমিন উদ্দিনের চোখে মুখে। ৫০ বছর আগে ইসলামাবাদ গ্রামে শ্বশুরের দেয়া ৬ কাঠা জমিতে ঘর তুলে তার নতুন জীবন শুরু। রাজমিস্ত্রি হিসেবে উপার্জিত অর্থ ও বসতভিটায় লাগানো নারকেল সুপারি থেকে বিক্রির কিছু অর্থ দিয়েই চলতো তার সংসার। এখন ১৫টি নারকেল আর ৩২টি সুপারি গাছের একটিও নেই তার বাড়িতে। লেণের প্রভাবে সব মরে শেষ। এক সময়ে সারা বছরের সুপারি তাকে কিনতে হতো না। এখন পানরি সঙ্গে সুপারি কিনতে হয় বৃদ্ধা আমিন উদ্দিনকে।চলতি পথে কথা হয় সদ্য অবসরে যাওয়া গিলাতলা আবুল কালাম মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক শেখ মিজানুর রহমানে সঙ্গে (৬২)। এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, রামপালের কুমালাই গ্রামে দাদার আমল থেকে তাদের বসবাস। ৯ বিঘার শত বছর আগের বাড়ি থাকলেও সেখানে আগের মতো কিছু নেই।তিনি জানান, ১৯৮৫ সাল থেকে তাদের এলাকায় লবণ বাড়তে থাকে। ৯৬ সালের পর লবণ পানিতে চিংড়ি চাষের প্রভাব এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে অর্থকরী ফসলের বেঁচে থাকা দায় হয়ে দাঁড়ায়। তার বাড়ির সুপারি গাছ থেকে প্রতি বছর ৩৫ মনণ সুপারি পেতো। ১ বিঘা জমিতে ধান হতো ৩৫ মণ। আর এখন সেই বাড়ি বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। তার ছোট ভাই শেখ দেলোয়ার রহমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানে এখন পুকুর কেটে মাছ ছাষ করছেন। জন্মস্থান বাস্তুভিটা ছেড়ে অনেক আগেই রামপালের গিলাতলায় তুলনামুলক উঁচু ৫ কাঠা জমি কিনে পরিবার নিয়ে সেখানে বাধ্য হয়েই বাস করছেন সদ্য অবসরে যাওয়া এই প্রভাষক।ইসলামাবাদ গ্রামের কাঠের ফার্নিচার ব্যবসায়ী আহম্মদ আলীর (৫২) স্ত্রী, কলেজ পড়ুয়া ছেলে সাইফুল্লাহ মাহমুদ এবং ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত নাবিল হাসানকে নিয়ে সংসার। ইসলামাবাদ গ্রামের ১৪ কাঠার বসতভিটায় ছিল তার নারকেল সুপারিসহ নানা ফলের গাছ। এখন তেমন কোনো গাছ নেই তার বাড়িতে। বসতঘরের পাশে মৎস্য খামার করেছেন আয়ের উৎস বাড়াতে।তিনি জানান, এখন মাছের দাম কম, পোনার দাম বেশি। মাছ চাষে আগের মতো লাভ নেই। তার মতে, খাল খনন করে পানি প্রবাহ রক্ষা করা গেলে আগের মতো জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা পলিমাটি জমিতে আসলে নারকেল সুপারির ফলন ফিরে আসবে। লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষের ফলে খাল খননসহ প্রবাহমান খালে বাঁধ অপসারণ হলে এ অঞ্চলের প্রকৃতির প্রাণ আবার ফিরে আসবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রামপালের পেড়িখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বাগেরহাট রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তালুকদার নাজমুল কবীর ঝিলাম বলেন, খাল বিল আটকে লবণ পানিতে দীর্ঘমেয়াদী চিংড়ি চাষের বিরূপ প্রভাব এখানকার সাধারণ মানুষের উপর পড়েছে। সরকার বাস্তবতার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক গতিধারা ফিরিয়ে আনতে নদী খাল খনন করছে। অপসারণ করা হছে প্রবাহমান খালের বাঁধ। এখনো এ কাজ অব্যাহত রয়েছে।তিনি আশা করেন, সরকারের এ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ যদি সকলের প্রচেষ্টায় সফল করা সম্ভব হয় তাহলে রামপালে লবণাক্ততার পরিমাণ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিক পরিবেশে পরিবর্তন অবশ্যই আসবে।১৩৩টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ১০টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে রামপাল উপজেলার আয়তন ২৭ হাজার ৬শ ৪৪ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলা কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, ১ লাখ ৭০ হাজার জনগোষ্ঠীর এ উপজেলায় জলাভূমির পরিমাণ ১ হাজার ১ শত ৪৮ হেক্টর আর কৃষি জমির পরিমাণ রয়েছে ১৯ হাজার ৩শ হেক্টর। বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি থাকলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাত্র ৬ হাজার ১ শ ৫৪ হেক্টর জমিতে আমন চাষের টার্গেট করা হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে জমি থাকলেও সবুজের সমারোহ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না এখানে।এসএস

Advertisement