অর্থনীতি

চাষিদের লিচু বাজারজাতকরণে ভূমিকা নিতে হবে সরকারকেই

মধুমাস জৈষ্ঠ্যের প্রায় মাঝামাঝি। গাছে গাছে লিচু পেকে আছে। গাছ ও বাগান মালিকরা ব্যাপারী খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। সরকার আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণের আশ্বাস দিলেও চাষিরা বলছেন, এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

Advertisement

বাজারব্যবস্থা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে লকডাউন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকেই এ ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাপারী বা ফড়িয়াদের সঙ্গে বাগান মালিকদের লিংক করে দেয়া এবং ব্যাপারীরা যাতে কোনো বাধা ছাড়া নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ বাগান মালিক-ফড়িয়া-ব্যাপারী-পাইকার ও খুচরা বিক্রেতদের মধ্যে যোগসাজশ একমাত্র সরকারই করতে পারে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের সহযোগিতা না পাওয়ায় এবার পোল্টি ও ডেইরি শিল্পে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সারাদেশেই তরিতরকারি, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যান্য কৃষি পণ্যেও একই অবস্থা। তবে সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী চাষিদের আশ্বস্ত করেন যে, দেশের খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, চাহিদা মোতাবেক সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় ফুড সাপ্লাইচেইন অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেট অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ফুড ফর ন্যাশন’ উদ্বোধন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে পারলে লিচু চাষিদের আর চিন্তা করতে হবে না।

এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পণ্য সাপ্লাই চেইন ভেঙে যাওয়ায় কোনো চাষিই তার পণ্যটি বিক্রি করতে পারছেন না। শুধু লিচু চাষি নন, সব চাষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারীরা বা ফড়িয়াদের সঙ্গে বাগান মালিকদের লিংক করে দেয়া এবং ব্যাপারীরা যাতে কোনো বাধা ছাড়া নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেন, সে ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে।

Advertisement

তিনি বলেন, যে যে জেলায় লিচু ভালো উৎপাদন হয়েছে, সে সে জেলার জেলা প্রশাসকরা চাষিদের এই ফল বাজারজাতকরণে উদ্যোগ নিতে পারেন। যেমন একজন ব্যাপারী দিনাজপুর থেকে লিচু এনে যেন ঢাকায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন, সে জন্য তাকে একটি টোকেন দিতে পারেন জেলা প্রশাসক। পথে কোনো সমস্যা হলে এই টোকেন দেখালে যেন তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। রাস্তায় যেন কোনো প্রকার হ্যাজার্ড (বিপত্তি) না হয়, সে ব্যবস্থা করলে ফল বাজারজাতকরণে কোনো সমস্যা হবে না।

এ বিষয়ে কথা হয় ইমেরিটাস প্রফেসর ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনার বিশেষজ্ঞ পুল সদস্য ড. এম এ সাত্তার মন্ডলের সঙ্গে।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো পণ্য বাজারজাতকরণ করতে সরকারের সহযোগিতা খুব বেশি প্রয়োজন। দীর্ঘদিন বসে থেকে সংসার পরিচালনার কারণে অনেক পাইকার বা ফড়িয়ার কাছেও এখন মূলধন নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার তাদের প্রণোদনা দিয়ে কৃষকের পণ্য বাজারজাতকরণে সহযোগিতা করতে পারে।

'করোনার এই সময়ে মৌসুমি ফল মানুষের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে খুবই প্রয়োজন। লিচু বাগান মালিক ও চাষিদের সঙ্গে পাইকারদের যোগসাজশ করে দিলে বাগানমালিকরা তাদের লিচু ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন',- বলেন তিনি।

Advertisement

গত ২৩ মে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণ নিয়ে এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, মহামারি করোনার কারণে শাকসবজি, মৌসুমি ফলসহ কৃষিপণ্যের স্বাভাবিক পরিবহন এবং সঠিক বিপণন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সময়মতো বিক্রি করতে পারছেন না। আবার বিক্রি করে অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না। বর্তমানে কৃষিপণ্যের বাজারজাত করা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, এ অবস্থায়, প্রান্তিক কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন এবং সেই সঙ্গে ভোক্তারা যাতে তাদের চাহিদা মোতাবেক সহজে, স্বল্প সময়ে এবং সঠিক মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে ‘ফুড ফর ন্যাশন’ প্ল্যাটফর্মটি চালু করা হয়েছে।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার লিচু চাষি মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, অন্যবার এ সময় বাগান বিক্রি হয়ে যেত। এই সময় সেই টাকা দিয়ে ধার-দেনা পরিশোধ করার পরও বিভিন্ন কাজে লাগানো যেত। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে এখন পর্যন্ত পাইকারি ব্যবসায়ীরা নামেননি। ফলে অধিকাংশ বাগান মালিকই বাগান নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন

তিনি বলেন, দিনাজপুর জেলা প্রশাসন লিচু মার্কেট কালিতলা নিউমার্কেট থেকে সরিয়ে দিনাজপুর বড় ময়দানের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে একমুখী লিচু বাজার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতারা এক দিক দিয়ে ঢুকবেন অন্যদিক দিয়ে বের হবেন। তারা যদি পাইকারদের আনতে পারেন তাহলে দিনাজপুরের লিচু চাষিরা দারুণভাবে উপকৃত হবেন।

মাগুরা জেলার শতখালী ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামের কামাল মোল্লা জাগো নিউজকে জানান, তার তিনটি বাগানে ২০০ লিচু গাছ রয়েছে। প্রতি বছর লিচুর মৌসুমের শুরু থেকে ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসতে শুরু করেন। পছন্দমতো দাম হলে তাদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। লিচু লাল হওয়া পর্যন্ত ব্যাপারীরাই নিজ উদ্যোগে বাগান পরিচর্যা করতেন। এ বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও লকডাউনের কারণে ব্যাপারীরা আসছেন না। ফলে নিজেরাই বাগান পরিচর্যা করছেন। শেষ পর্যন্ত খরচ তুলতে পারবেন কি না শঙ্কায় আছেন।

ঈশ্বরদী উপজেলার চাঁদপুরচরের লিচু চাষি আলম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এবার আমি প্রায় ১০ বিঘার ৮টা বাগান ইজারা নিয়েছি। সেখানে ১০০টির মতো লিচু গাছ রয়েছে। বাগান প্রতি ইজারা ব্যয় ও কিটনাশকসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয়বাবদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও ফলন ভালো। এরইমধ্যে কিছু গাছে লিচু পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এবার ঢাকার পাইকাররা আসেননি। আসবে কি না জানি না, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তয় আছি। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে লিচুর ক্ষতি হয়েছে। শতভাগ ফলন পাব না। এর মধ্যে যদি দাম না পাই তাহলে আমাদের খুব ক্ষতি হবে।

রাঙ্গামাটি জেলার সদর উপজেলার বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের লিচু বাগানের মালিক সুমতি রঞ্জন চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, আমার বাগানে ২০০ লিচু গাছ রয়েছে। এ বছর লিচুর উৎপাদন খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ কী হবে, লিচুর দাম পাচ্ছি না। গত বছর ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগানে এসে ফল পাকবার আগেই পুরো বাগান কিনে নিয়েছিল। এই বছর তারা আসেনি। বাজারে নিজে বিক্রি করতে গিয়েও দাম পাচ্ছি না। করোনার কারণে আমাদের সব ফল ফসল বিক্রিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক।

এফএইচএস/জেডএ/পিআর