মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে দুই মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের শেয়ারবাজারের লেনদেন। বন্ধ হয়ে গেছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আয়। ফলে চাকরি হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীরা। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ব্রোকারেজ হাউস কর্মীদের বেতনও আটকে দিয়েছে। ফলে ঈদের আনন্দ অনেকটাই মাটি হয়ে গেছে তাদের।
Advertisement
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছে ২০০৯ ও ২০১০ সালে। ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হতো। ফলে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আয় ছিল বেশ। বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতিতে জমজমাট থাকত প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউস।
২০১০ সালের মহাধসের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন ভাটা পড়ে। ফলে ব্রোকারেজ হাউসের আয়ে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত দেড়-দুই বছর ধরে যে লেনদেন হচ্ছে তা দিয়ে ব্রোকারেজ হাউসের খরচের এক-তৃতীয়াংশের মতো উঠছে। অর্থাৎ মাসে ব্রোকারেজ হউস মালিককে প্রায় ৭০ শতাংশের মতো ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জনা গেছে, আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় ২০১০ সালের মহাধসের পর একদফা ছাঁটাইয়ের কবলে পড়েন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীরা। ফলে ২০১০ সালে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে যে পরিমাণ কর্মী ছিল বর্তমানে তার অর্ধেকের মতো আছেন।
Advertisement
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ডিএসইর স্টেকহোল্ডারদের প্রধান কার্যালয় ২৪২টি। এর সঙ্গে এক্সটেনশন অফিস আছে ৪২৫টি এবং শাখা অফিস আছে ৬২৯টি। এই অফিসগুলোতে বর্তমানে ১০ হাজারের মতো কর্মী আছেন। ২০১০ সালের দিকে কর্মীর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজারের ওপরে।
ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে লেনদেন বন্ধ থাকায় আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদের পর শেয়ারবাজার খুললেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না। কারণ শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে লেনদেনের পরিমাণ কমে গেছে। সহসা লেনদেন বাড়ার সম্ভাবনা খুব কম।
ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা লান্টু বলেন, হাউসগুলো মূলত চলে লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশনের ওপর। ২০১০ সালের ধসের পর থেকেই শেয়ারবাজারে লেনদেন খরা চলছে। প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউস ভর্তুকি দিয়ে চলছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অবস্থা আরও দুর্বল করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, দুই মাস ধরে মালিকের আয় নেই। তারপরও মালিকপক্ষ আমাদের বেতন দিয়েছে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? ঈদের পর লেনদেন চালু হলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না। ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হবে না। দেখা যাবে দিনে একশ-দেড়শ কোটি টাকার লেনদেন হবে। এমন লেনদেন হলে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর তো দৈনন্দিন খরচই উঠবে না। এ পরিস্থিতিতে কার চাকরি থাকবে, কার থাকবে না; কেউ বলতে পারেন না। সুতরাং ঈদের আনন্দের চেয়ে এখন আমাদের দুশ্চিন্তাই বেশি।
Advertisement
পার্কওয়ে সিকিউরিটিজের এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজার যখন ভালো ছিল মালিক আমাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। এখন দুই মাস ধরে লেনদেন বন্ধ, তারপরও ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ করেছেন। মালিক ভালো হওয়ায় কিছু বলছেন না। কিন্তু এ অবস্থা কতদিন চলবে? সামনে লেনদেন চালু হলেও শেয়ারবাজারের পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। করোনার কারণে সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সামনে শেয়ারবাজারের লেনদেন কমে যাবে। এছাড়া লেনদেন ফ্লোর প্রাইসের একটি প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতি সামনে কিছু ছাঁটাই হবে— এটা আমরা মানসিকভাবে ধরেই নিয়েছি।
এদিকে বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউস কর্মীদের বেতন পরিশোধ করলেও কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন আটকে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজের এক কর্মী বলেন, শেয়ারবাজারে লেনদেন নেই। আমাদেরও আয় বন্ধ। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বুঝতে পারছি না। আবার ঈদের পর লেনদেন চালু হলে চাকরি কতদিন থাকবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বর্তমানে আমরা আর্থিক ও মানসিক, সবদিক দিয়ে সমস্যায় রয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আনন্দ কীভাবে আসবে? মহামারি করোনাভাইরাস আমাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সদস্য বলেন, এমনিতেই হাউসগুলো পরিচালনা করতে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে রয়েছি। এর মধ্যে দুই মাস ধরে লেনদেন বন্ধ। শেয়ারবাজার চালুর পর লেনদেনের গতি আরও কমার সম্ভাবনা বেশি। এমন পরিস্থিতিতে হাউসগুলো নিজেদের বাঁচাতে অবশ্যই খরচ কমানোর চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে হয়তো কিছু কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হতে পারেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, করোনাভাইরাসের আগে থেকেই ব্রোকারেজ হাউসগুলো লোকসানে রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে দুই মাস ধরে শেয়ারবাজার বন্ধ। এতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আয়ও বন্ধ। এরপরও আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস সবই পরিশোধ করেছি।
অনেক ব্রোকারেজ হাউস কর্মকর্তাদের বেতন আটকে দিয়েছেন এবং অনেকে ঈদের পর চাকরি হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শাকিল রিজভী বলেন, এসব কর্মকর্তা অনেক দিন ধরেই আমাদের সাথে রয়েছেন। মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও এই সংকটের সময় তাদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, চাকরি হারানোর শঙ্কা সব সেক্টরেই আছে। করোনাভাইরাসের আগে থেকেই ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে অতিরিক্ত কর্মী রয়েছে। মার্কেট ভালো হবে, সবাই এই আশায় ছিলেন। বাজার খোলার পর হয়তো একটা ধাক্কা লাগতে পারে। তবে আমি মনে করি হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ সংকটের পর অনেক সুযোগ আসে।
এমএএস/এমএআর/এমএস