মুম্বাইয়ে যা ঘটলো টেলিভিশন পর্দায় সেটা দেখতে দেখতে এক রাজপুতের কথা মনে পড়ে গেলো। এক সময় ভারতীয় ক্রিকেটে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মিডিয়ার সঙ্গেও প্রচুর কথা বলতেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোকও একবার টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট নিয়ে তাঁর জীবনের সংক্ষিপ্ততম বিবৃতি দিয়েছিলেন। এবং বলেছিলেন;‘দিজ ইজ নট ক্রিকেট!’ ভারতের সাবেক বোর্ড সভাপতি রাজসিংয়ের দুঙ্গারপুরের সেই বক্তব্যটা মনে আছে বলে সোমবারের মুম্বাইয়ের ঘটনাকে কোনোভাবে আর নজিরবিহীন বলতে পারছি না। যারা লিখছেন নজিরবিহীন ঘটনা, ইতিহাসের পাতা উল্টে তাদের দু’একটা নজির মনে করিয়ে দিতে চাই।এক. ১৯৯১ সালে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল কোদালের কোপে। দুই. ১৯৯৯ সালে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা অনিল কুম্বলের তাণ্ডব ( ইনিংসে দশ উইকেট) দেখার আগে দেখেছিলেন বাইশ গজে অন্য এক তাণ্ডব। তিন. এরপর মুম্বাইয়ে বিসিসিআই এর অফিসে ভাঙচুর। তিরাশির বিশ্বকাপ ছত্রখান। শারজা কাপ, এশিয়া কাপ সব লণ্ডভণ্ড। ঘরভরা কাঁচের টুকরো। আর সেই সময়ে রাজসিং দুঙ্গারপুরের ভারতীয় বোর্ডের প্রশাসনিক সচিব শরদ দিবাকর রক্তাক্ত অবস্থায়! এবং যা ঘটেছিল তার সবটাই হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠন শিবসেনার সৌজন্যে!ভারতের দুদে আইনজীবী নতুন বোর্ড সভাপতি শশাঙ্ক মনোহরের এই ইতিহাসের পুরোটাই জানা। ভালো করেই জানা। যেখানে শিবসেনা এর আগে ভারতীয় বোর্ডের কার্যালয় ভাঙচুর করেছে এর আগে সেখানে এবার তারা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি শাহরিয়ার খানের নামে ‘গো ব্যাক শাহরিয়ার খান’- প্লেকার্ড লিখে বোর্ডের ভেতর ঢুকে শশাঙ্ক বাবুর সামনে বিক্ষোভ দেখালে সেটা মোটেও নতুন কিছু নয়। এবং তার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা শশাঙ্ক মনোহরেরও নেই। অতএব বুদ্ধিমানের মতো তিনি সব শুনলেন। দেখলেন। তারপর শাহরিয়ার খানের সঙ্গে পাক-ভারত ক্রিকেট আলোচনা মুম্বাইয়ে বাতিল করলেন! কোনো ক্রিকেট দল নয়, প্রতিবেশি একটা দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির নিরাপত্তা দেয়া যেখানে সম্ভব হলো না, সেই দেশটা কিন্তু ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ! অন্তত সাউথ আফ্রিকানদের কাছে! কারণ, তারা ভারত সফর করছে। কটকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির সময় ভারতীয় সমর্থকরা মাঠে বোতল ছুঁড়লেন। খেলা বন্ধ থাকলো। রাজকোটে তৃতীয় ওয়ানডের আগে হার্দিক এর বিক্ষোভের মুখে স্টেডিয়ামের দুই তিন কিলোমিটার জুড়ে মিনি ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে ফেলা হলো বিক্ষোভকারীদের সামাল দিতে! তারপরও ভারত নিরাপদ! কারণ, ভারতে খেললে প্রচুর ডলার পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশে সাউথ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দল পাঠাতেও আপত্তি। সফর বাতিলও করলো তাঁরা! বাংলাদেশ বনে গেলো অনিরাপদ!মুম্বাই নিরাপদ! কারণ, মুম্বাইয়ে এতো কিছু ঘটার পরও তা নিয়ে কোন টক-শো হয় না। যে মুম্বাই বড় বড় নামকরা ক্রিকেটার প্রসব করেছে তারা কেউ টু শব্দ করেন না! সবাই ‘নন কমিটাল’! তা সেই বড় বড় নামের তালিকায় শচীন টেন্ডুলকার, সুনীল গাভাস্কার, দীলিপ ভেঙ্গসরকার, রবি শাস্ত্রী, অজিত ওয়াদেকার, সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার যাই হোক না কেন! সবাই নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চান। শিবসেনার বিরাগ ভাজন কেউ হতে চান না। মুম্বাইকররা না হয় চুপ থাকলেন, কিন্তু ভারত বর্ষে আরো কিছু ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব আছেন। তারাও চুপ! পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট নাই বা খেললেন। তাই বলে ক্রিকেট নিয়ে সে দেশের বোর্ড সভাপতির সঙ্গে কথাও বলা যাবে না! আলোচনাও বসা যাবে না! অথচ বলতে হবে ভারত ক্রিকেটের অন্যতম প্রধান শক্তি? মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকলে কি বলতেন জানি না! হয়তো তাঁর সেই পুরনো কথাটা নতুন করে ক্রিকেটকে ঘিরে বলতেন; ‘জীবিত অবস্থায় ক্রিকেটকে শবশ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে!’ প্রয়াত রাজসিং দুঙ্গারপুর বিতর্কিত অনেক কথা বলেছেন ক্রিকেট প্রশাসনে বসে। কিন্তু তাঁর সংক্ষিপ্ততম বাক্যটা নিখাদ সত্য-‘দিজ ইজ নট ক্রিকেট!’ কথাটার কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানি না। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করার জন্য যে দেশের বোর্ড সভাপতির রুমে ঢুকে তাঁর সামনে জনাপঞ্চাশেক উগ্রবাদী লোক যা করলেন এবং মিস্টার মনোহর তাদের সামনে যেভাবে জবুথবু অবস্থায় বসে থাকলেন, সেটা দেখার পর একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করছে, অস্ট্রেলিয়ানরা বাংলাদেশে নিরাপত্তার অভাব দেখেছিলেন। কিন্তু ভারতে ঠিকই আসবে।আসলে সবচেয়ে নিরাপত্তা বর্ম-টা হচ্ছে ডলার! বাংলাদেশ পৃথিবীর নিরাপদতম দেশ, সে দাবি হয়তো করা যাবে না। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে ঢুকে এদেশের কোনো বোর্ড প্রেসিডেন্টের সামনে উগ্রতার এরকম চরম নিদর্শন কেউ দেখাতে পারেনি। পারবেও না। বাকি ক্রিকেট বিশ্ব এখন নিরাপত্তার সংজ্ঞা অন্যভাবে খুঁজলে খুঁজতেও পারে।লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভিএইচআর/পিআর
Advertisement