করোনাভাইরাসের কারণে বিরাট অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কার সম্মুখে পুরো বিশ্ব। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নেই ইউরোপের উন্নত দেশগুলো। তবে সংকট মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ নানা ধরনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। করোনার এই ক্রান্তিকালে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি বিশেষ করে অবৈধভাবে বসবাসকারীরা আছেন চরম বিপাকে। আর তাদের কথা মাথায় রেখেই ইতালি এবং পর্তুগাল-ইউরোপের প্রথম সারির এই দেশ দুটি তাদের অভিবাসী নাগরিক আইনে কিছুটা শিথিল এনে বিশেষ সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতা মঙ্গলবার (১৯ মে) স্পেনের সংসদ অধিবেশনে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধকরণে একটি প্রস্তাব উঠেছে।
Advertisement
সিনেটর পিকরনেল গ্রেন্সনা দেশটির অভিবাসীবিষয়ক মন্ত্রীর উদ্দেশে এই প্রস্তাবটি আনেন। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর সরকার জোর দাবি দিয়ে বলে যাচ্ছে, এই ভাইরাস আমরা সবাই একত্রে মিলে প্রতিহত করব এবং এ থেকে কাউকে পিছনে পড়ে থাকতে দেবে না। সরকার যদি আসলেই তা মনে করে তাহলে স্পেনে যত অবৈধ অভিবাসী আছে তাদের সকলকেই এখন বৈধতা প্রদান করা উচিত। যদি বৈধ কাগজ না থাকে তাহলে তারা তাদের অধিকার ঠিকমতো আদায় করতে পারে না। এটা আসলে এই সময় খুবই ভাবনার বিষয়, বিশেষ করে কোভিড-১৯-এর মহামারির এই সময়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কাগজ না থাকে তাহলে কাজ থাকে না, কাজ না থাকলে থাকে না একটা ভালো বেতন, কোনো ভালো বাসা থাকে না, না থাকে একটা মর্যাদাপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। যা সমাজ থেকে তাদের আলাদা করে দেয়, তাই আমাদের এদের প্রয়োজনে যা কিছু করা দরকার তা করা উচিত।’
বর্তমান এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতালি ও পর্তুগালের সরকার তাদের দেশের অভিবাসীদের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এ সময় তা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে সিনেটর।
Advertisement
জবাবে দেশটির সামাজিক নিরাপত্তা ও অভিবাসীবিষয়ক মন্ত্রী খোসে লুইস এসক্রিভা বেলমন্তে জানান, পর্তুগাল বা ইতালি যা করেছে তা কিছু শর্তাবলীর ওপরে করেছে। ইউরোপীয় রিফিউজি অধ্যাদেশ ২০০৮-এ বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সাধারণভাবে অভিবাসীদের বৈধ করা যাবে না। এবং তা এখনও কেউ ভঙ্গ করেনি। তবে একটু ব্যতিক্রমিভবে পর্তুগাল যা বের করেছে এটা স্পেনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার কিছুই নেই। কেননা পর্তুগালে যাদের বৈধ কাগজ নেই তারা চিকিৎসা সেবা পায় না কিন্তু স্পেনে সেটা পায়। আর যা ইতালি করছে-একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা ধরে রাখতে তার দেশের কৃষিখাতে কাজ করার জন্য লোক নিচ্ছে। এটাও স্পেনের সঙ্গে যায় না। কেননা স্পেন অস্থায়ী ভিত্তিতে অবৈধ বসবাসকারী ১৮ থেকে ২১ বছরের মানুষদের জন্যও মাঠে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। এ দুটি কারণেই স্পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ আইনের কোনো ক্যাটাগরিতে পড়ে না। তাই স্পেনের পক্ষে বিশেষ কোনো প্রস্তাবনায় এদেশে অবৈধ জনবলকে বৈধকরণের কোনো সুযোগ নেই।
তবে মন্ত্রী সিনেটরকে পুরোপুরি আশাহত করেননি, কিংবা তার প্রস্তাবটি পুরোদস্তুর উড়িয়ে দেননি। তিনি সিনেটরের প্রস্তাবনা গ্রহণ করে জানান, তার সরকার ইতোমধ্যে এই প্রস্তাবনার আলোকে কাজ করে যাচ্ছে এবং তারা নিজেরা আরও চেষ্টা করছেন এ বিষয়ে আরও কিছু করা যায় কি-না। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অবৈধ অভিবাসীরা কিছু সুবিধা পেয়েছেন। এবং আরও কিছু করা যায় কি-না, সে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। বিশেষত ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রের অভিবাসী সচিব এই বিষয়ে কাজ করছেন এবং দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বিষয়টি অবগত আছেন।
দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন জানায়, স্পেনে সোশ্যালিস্ট পার্টির সরকার অভিবাসীবান্ধব সরকার হিসেবেই পরিচিত। বর্তমান সোশ্যালিস্ট পার্টির সরকারের আমলে ২০০৫ সালে অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ও সহজ শর্তে বৈধতা দেয়া হয়।
২০১৬ সালের ২৪ জুন স্থানীয় গণমাধ্যম ‘ইউরোপা প্রেস’-এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছিলেন সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান পেদ্রো সানচেজ। অবৈধদের বৈধভাবে দেশটিতে বসবাস করার ব্যবস্থা নেয়ার আগ্রহের কথা বলেছিলেন তিনি। বর্তমানে ক্ষমতায় আছে সোশ্যালিস্ট পার্টি। তাই তারা অভিবাসন নীতি নমনীয় করবে- এমনটি প্রত্যাশা করছেন স্পেনের অভিবাসীরা।
Advertisement
দেশটিতে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা নিবন্ধনকৃত মানবাধিকার সংগঠন ‘ভালিয়েন্তে বাংলার’ সভাপতি ফজলে এলাহি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি তাতে পুরো স্পেনে প্রায় ১০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি আছেন, তারা স্পেনে বসবাস করার অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। স্পেনের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে এ সরকারের কাছে আমরাও দাবি জানিয়েছি, যাতে অভিবাসীদের সহজ শর্তে বৈধতা দেয়া হয়।’
প্রধানমন্ত্রী সানচেজ তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাজ করলে স্পেনে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ তৈরি রয়েছে বলে জানান ফজলে এলাহি।
স্পেনে বাংলাদেশি সমাজকর্মী ও অনুবাদক নাসিরুল ওয়াহাব অপু বলেন, ‘সরকার এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। হয়তো অচিরেই আমরা ভালো সংবাদ পেতে পারি অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার বিষয়ে।’
অতীতে দেখা গেছে, সোশ্যালিস্ট পার্টি যখন স্পেনের রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে তখন অভিবাসীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান খসে লুইস রদ্রিগেজ জাপাতেরো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময় অবৈধ অভিবাসীরা সহজ শর্তে স্পেনে বসবাসের বৈধতা পেয়েছেন। বিশেষ করে ২০০৫ সালে সাধারণ ক্ষমা ও সহজ শর্তে বৈধতা পেয়েছেন কয়েক হাজার অভিবাসী।
ইতোমধ্যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্পেনে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, বছরের পর বছর অবৈধ অভিবাসীরা ব্যবসাসহ বিভিন্ন রকমের পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। অথচ এসব অবৈধ অধিবাসীদের বৈধতা দিলে বৈধ কাজ করে নিয়মিত সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করতে পারবে। এতে দেশটির অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
স্পেনের অর্থনীতির মূল খাতগুলোর মধ্যে কৃষি ও পর্যটন শিল্প প্রধান। করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই দেশটির পর্যটন শিল্পে ধস নামে। পুরো স্পেন বর্তমানে পর্যটকশূন্য অবস্থায় রয়েছে। কৃষিখাতেও ধ্বংস অবধারিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাস্তিইয়া লা মানছা, ভ্যালেন্সিয়াসহ কয়েকটি এলাকা কৃষিকাজের জন্য প্রচুর কাজের লোকের সঙ্কট শুরু হয়েছে।
স্পেনের অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, দেশটিতে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশিসহ অবৈধ হয়ে পড়া মোট অভিবাসীর সংখ্যা দুই লাখ। দেশটির এই দুঃসময়ে সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে আশার কোনো নতুন সূর্য উদিত হয় কি-না, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন এই বিপুলসংখ্যক অভিবাসী।
এসআর/এমএস