ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে দেশের এক হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্টসহ অবকাঠামোর পাশাপাশি ঘরবাড়ি, কৃষি ও চিংড়ি ঘেরসহ মাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
Advertisement
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আম্ফানের তাণ্ডবে সারাদেশে প্রায় ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানার আগের দিন থেকে বিদ্যুৎহীন রয়েছেন দেশের ২৫টি জেলায় প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
উপকূলীয় অঞ্চলের বাইরে যেসব জেলায় সাধারণত ঘূর্ণিঝড় হয় না, সেসব জেলাতেও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলার পানের বরজ থেকে শুরু করে রাজশাহীতে মৌসুমি ফল আম এবং উত্তরের অন্য জেলাগুলোতে ধান ও সবজির অনেক ক্ষতি হয়েছে।
এসব এলাকার অনেকে বলেছেন, বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতি না থাকায় আম্ফানের তাণ্ডব দেখে খুবই অবাক হয়েছেন তারা।
Advertisement
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে দেশের ৪৬টি জেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব জেলায় বিভিন্ন হারে মোট এক লাখ ৭৬ হাজার ৭ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে ঝিনাইদহ-যশোর পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষের ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ধারণা খুবই কম। সেখানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সারারাত ঝড়ের তাণ্ডব এই অঞ্চলের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী উজিরপুর গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী সমাজকর্মী এমদাদুল হক বলেন, এমন ঝড়ের সঙ্গে তারা পরিচিত ছিলেন না। এ রকম ঝড় আগে কখনো দেখেননি। কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে বা বিভিন্ন সময় নিম্নচাপের সাথে ঝড় হয়েছে, কিন্তু এমন ব্যাপক ঝড় কখনও হয়নি। এ কারণে কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। জমির ধান পানির নিচে চলে গেছে। পাটের আগা ভেঙে গেছে। ঘরবাড়ি ও অনেক গাছ ভেঙে গেছে।
যশোরসহ এসব অঞ্চলের জেলাগুলোতে একরের পর একর জমিতে পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পান গাছের লতা বাঁশের খুঁটি দিয়ে উঠিয়ে রাখা হয়, সেটাকে বরজ বলে। অধিকাংশ পানচাষিরা সাধারণত বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পান চাষ করে থাকেন।
Advertisement
যশোরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের চাষি হারুনর রশিদ শাওন বলেন, তার চাষ করা দুই বিঘা জমির পানের বরজ পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ঝড়ে পানের বরজ মাটিতে শুয়ে গেছে। এটা পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেল।
এবার রাজশাহী অঞ্চলেও দাপট দেখিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। সেখানে মৌসুমি ফল আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমচাষীরা বলছেন, প্রায় ২৫ শতাংশ আম ঝড়ে পড়ে গেছে।
আমের ক্ষতি বেশি হয়েছে রাজশাহীর বাঘা এলাকায়। সেখানকার একজন আমচাষি বলেন, অনেক পরিচর্যা ও টাকা খরচ করে ভালোই আম হয়েছিল। কিন্তু এই ঝড়ে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা বলার ভাষা নেই। এত আম পড়ে গেছে যে গাছের নিচে শুধু আম আর আম, মাটি দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ঝড়ের কারণে মাটিতে পড়ে নষ্ট হওয়া এই আম ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মানে ৭৫ কেজির এক বস্তা আম মাত্র ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা কীভাবে বাঁচবো?
চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার আম বাগানগুলোতে অবশ্য সেরকম ক্ষতি হয়নি। এছাড়া বগুড়াসহ উত্তরের জেলাগুলোতে ধান এবং সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বগুড়ার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী হোসনে আরা বলেন, উপকূলের বাইরের জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে অভিজ্ঞতা না থাকায় এসব জায়গায় ক্ষতি বেশি হয়েছে। এই নন-কোস্টাল বেল্টে মানুষের প্রস্তুতি থাকে না। সেজন্য এই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে যায়। তাছাড়া ক্ষতিও হয়েছে অনেক।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সারাদেশে ধানের বেশিরভাগই আগে কেটে ফেলা সম্ভব হয়েছে। সেজন্য জমিতে থাকা ধানের ১০ শতাংশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ডাল ও আমের বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আম আগে বাজারে আসে সাতক্ষীরা থেকে। ঘূণিঝড়ের কারণে সেখানে ৬০ শতাংশ আমই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, রাজশাহী ও সাতক্ষীরায় ঝড়ের কারণে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া আম সরকারিভাবে কিনে আমচাষিদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
এদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলছেন, এই ঝড়ে যতটা ক্ষতি আশংকা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি। সেটা তাদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মাঝে ক্ষতি যা হয়েছে, সেটাও কম নয়।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এমএসএইচ/এমএস