জাতীয়

স্বচ্ছ নীল জলে নৈসর্গিক হাতিরঝিল

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে মানুষের পদচারণা কমে যাওয়ায় অনেকটাই প্রকৃত রূপ ফিরে পেয়েছে হাতিরঝিল। ঝিলের পানি স্বচ্ছ রূপ ধারণ করার পাশাপাশি দূর হয়েছে দুর্গন্ধও। গাছ-গাছালি, পথের দুপাশের ঘাস আরও সবুজ হয়ে অনিন্দ্য সুন্দর রূপ ধারণ করেছে হাতিরঝিলের পুরো এলাকা। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়কে দূরে ঠেলে যুগলসহ প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসছেন হাতিরঝিলে।

Advertisement

যান্ত্রিক নগরবাসীর বিনোদনের জন্য হাতিরঝিলকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। ঢাকা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই মনোরম স্থানটির চারপাশের এলাকাগুলো হলো তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, নিকেতন, মগবাজার। উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটা রাজধানীবাসীর জন্য নববর্ষের উপহার।

তারপর থেকেই রাজধানীবাসীর বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয় হাতিরঝিল। বিভিন্ন উৎসব ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মহানগরসহ ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাতিরঝিলে ছুটে আসতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। ফলে বিনোদনের এই কেন্দ্রটি প্রায়ই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।

উৎসবের দিনগুলো ছাড়াও সাধারণ দিনগুলোতেও মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে হাতিরঝিল। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে, কেউ প্রিয় মানুষকে নিয়ে ঘুরতে বের হন হাতিরঝিলে। তবে যত্রতত্র ময়লা ফেলায় একদিকে হাতিরঝিলের পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে, অন্যদিকে পানি দুর্গন্ধ হয়ে পড়ে।

Advertisement

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে মানুষের পদচারণা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় হাতিরঝিলে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই প্রকৃত রূপে ফিরতে শুরু করে হাতিরঝিল। দুর্গন্ধময় পানি আবার স্বচ্ছ রূপে ফিরে পায়। রাস্তার দুপাশ, ঝিলের পাড়ের ঘাস আর গাছ-গাছালিতে বাড়ে সবুজাভ মায়া।

করোনার কারণে কড়াকড়ি থাকলেও হাতিরঝিলের এই সৌন্দর্য দেখতে আবারও রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি অথবা আশপাশের বাসিন্দা।

প্রিয় মানুষের সঙ্গে বনানী থেকে হাতিরঝিলে আসা নীলিমা বলেন, করোনার ভয়ে অনেকদিন ধরেই ঘরে বন্দী হয়ে আছি। এভাবে ঘরবন্দি হয়ে আর কতদিন থাকা যায়। তাই দুজনে মিলে একটু ঘুরতে বেরিয়েছি। হাতিরঝিলে কিছু সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে যাব।

তিনি বলেন, হাতিরঝিলে আগেও এসেছি। কিন্তু এতো ভালো আগে কখনো লাগেনি। কোথাও কোনো দুর্গন্ধ নেই। মানুষের গাদাগাদিও নেই। কী সুন্দর নির্মল পরিবেশ। পানি কি চমৎকার নীল স্বচ্ছ রূপ ধারণ করেছে। হাতিরঝিলের এমন রূপ দেখতে পাবো কখনো ভাবেনি।

Advertisement

ধানমন্ডি থেকে আসা রোহান বলেন, এখন হাতিরঝিলের যে রূপ দেখা যাচ্ছে এটাই প্রকৃত সৌন্দর্য। হাতিরঝিলের রূপ দেখে সত্যিই মুগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে হয়তো এই রূপ বেশিদিন থাকবে না। মানুষের পদচারণা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতিরঝিল আগের রূপে চলে যাবে। এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে।

করোনার মধ্যে ঘুরতে বের হয়েছেন বলে ভয় লাগে না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভয় তো লাগেই। তাই বললে সব সময় তো ঘরন্দি হয়ে থাকা যায় না। মাঝেমধ্যে বাইরের আলো-বাতাসে বের না হলে উল্টো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব। আর এ মুহূর্তে বের না হলে হাতিরঝিলের এমন রূপ কিভাবে দেখতে পেতাম।

এদিকে হাতিরঝিলের আশপাশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতিদিনই আশপাশের বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হয়ে হাতিরঝিলের নির্মল বায়ুতে প্রাণভরে শ্বাস নেন। আগের মত হাতিরঝিলে মানুষের গাদাগাদি নেই, ফলে পরিবেশ বেশ শান্ত-মনোরম। তবে প্রতিদিনই হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে প্রচুর প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল যাতায়াত করে। অনেকে প্রাইভেটকার নিয়ে ঘুরতেও আসেন।

হাতিরঝিলের তেজগাঁও অংশের বাসিন্দা আকলিমা বলেন, করোনার কারণে প্রথমদিকে হাতিরঝিলে কেউ ঘুরতে আসতো না। তবে কিছুদিন ধরে অনেকেই গাড়ি নিয়ে এখানে ঘুরতে আসছেন।

তিনি বলেন, মানুষ আসা বন্ধ হলেও আমরা কয়েকজন প্রায় প্রতিদিনই আসি। অন্ধকার ঘরে গরমে ভালো লাগে না। তাই মাঝেমধ্যে হাতিরঝিলে এসে বসে থাকি। বেশ ভালো লাগে। আমাদের চোখের সামনেই হাতিরঝিলের ময়লা পানি এমন স্বচ্ছ রূপ নিয়েছে। মানুষ আসা বন্ধ হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পানি স্বচ্ছ হয়ে উঠে।

হাতিরঝিল সংলগ্ন একটি বাসার বাসিন্দা জহির বলেন, আগে প্রতিদিন শত শত মানুষ হাতিরঝিলে আসতো। সাপ্তাহিক ছুটির দিন অথবা সরকারি ছুটির দিনে মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠত এই বিনোদন কেন্দ্রটি। করোনার কারণে দুই মাস ধরে মানুষের সেই আনাগোনা নেই। ছোট্ট একটা ভাইরাস মানুষকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। অবশ্য একদিক থেকে ভালো হয়েছে যে, প্রকৃতি তার আসল চেহারা ফিরে পেয়েছে।

তিনি বলেন, দুই মাস আগের হাতিরঝিল, আর এখনকার হাতিরঝিলের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আগে মানুষ হাতিরঝিলের ভেতর নাক চেপেও হাঁটতো। এখন হাতিরঝিলের কোথাও দুর্গন্ধ নেই। মানুষের আনাগোনা খুব কম। আশপাশের বাসিন্দাদের কেউ কেউ ঘুরতে আসেন। দূরের কেউ খুব একটা আসেন না। মাঝেমধ্যে গাড়ি নিয়ে কেউ কেউ আসেন। খোশগল্প করে, ছবি তুলে ফিরে যান। কেউ পানিতে ময়লা ফেলেন না। এটা দেখে বেশ ভালো লাগে।

জহির আরও বলেন, সপ্তাহখানেক ধরে হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বেড়েছে। আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে আস্তে আস্তে মানুষের আনাগোনা বাড়লে হয়তো হাতিরঝিল আবার আগের চেহারায় ফিরে যাবে।

এমএএস/এইচএ/পিআর