প্রবাস

বিপদ বেড়েছে মালয়েশিয়ায় অবৈধ প্রবাসীদের

বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে প্রায় ৮ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন, যাদের বড় অংশই শ্রমিক। চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলো কড়া নজরদারিতে রেখেছে সরকার। করোনা সন্দেহ হলেই ওইসব এলাকা সঙ্গে সঙ্গে লকডাউন করা হচ্ছে।

Advertisement

এক সপ্তাহ আগে রাজধানী কুয়ালালামপুর শহরের পুডু এলাকা করা হয়েছে লকডাউন। এ এলাকায় বাংলাদেশি, মিয়ানমার, নেপালিদের বড় একটি অংশ রয়েছেন। সেখানে বসবাস করা সকলের করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। একই সময়ে যাদের ভিসা নেই বা ইমিগ্রেশন আইন ও এমসিও ভঙ্গ করে তাদের আটক করা হচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশিসহ প্রায় ২শর অধিক অভিবাসীকে আট করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ অভিবাসীরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

পুডু এলাকায় লকডাউনে থাকা কয়েকজন অভিবাসী ফেসটুন হাতে নিয়ে তাদের সমস্যা ও দেশে থাকা তাদের পরিবারের সমস্যার কথা জানান দিচ্ছেন। একদিকে বিদেশিকর্মীদের কাজ করার ক্ষেত্রে করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে মালয়েশিয়া সরকার। বৈধকর্মীদের ক্ষেত্রে কোম্পানি বা সকসো করোনা টেস্ট এর খরচ দিচ্ছে। কিন্তু অবৈধ প্রবাসীরা রয়েছেন অনিশ্চয়তায়।

যদিও মালয়েশিয়া সরকার বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে সকলকে করোনা টেস্ট করার আহ্বান জানিয়েছে। লকডাউনের কারণে ১৮ মার্চ থে ৪ মে পর্যন্ত কাজ কাজ বন্ধ থাকার পর সীমিত আকারে নানা শর্তাধীনে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করার অনুমতি পেয়েছে। সেখানে কিছু সংখ্যক বিদেশিকর্মী কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু যারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতেন তারা নানা বিধিনিষেধের কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

Advertisement

আর যে সকল কর্মী নিয়োগকর্তার অধীনে আছেন কিন্তু তাদের কাজ বন্ধ থাকায় আয় সেভাবে আগের মতো নেই। ফলে সকল প্রবাসীরা ভাবছেন দেশে থাকা তাদের পরিবারের কথা। তারা তাদের আয়ের সিংহভাগই দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। লকডাউনের কারণে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন না। ফলে আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো।

পুডু এলাকায় লকডাউনে থাকা হোসেন কবির যিনি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি বিদেশি নাগরিক বসবাস করছেন। আমরা দুই মাস ধরে কাজে যেতে পারিনি। এর মধ্যেই পুডু এলাকা দেয়া হয়েছে লকডাউন। আরও কঠিনভাবে চলাচলে আরোপ করা হয়েছে বিধি-নিষেধ। বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না কাউকে।

হোসেন কবির বলেন, কর্মহীন, অর্থসংকটে রয়েছি আমরা। একদিকে নিজের চিন্তা, অন্যদিকে দেশে থাকা পরিবার পরিজন নিয়ে চিন্তা। দুই মাস গত হয় দেশে টাকা পাঠাতে পারিনি। পরিবার খুব কষ্টে আছে।

কুয়ালালামপুরের জালান ইপুহ এলাকায় একটি স্যালনে গত আড়াই বছর ধরে কাজ করতেন উজ্জল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার লকডাউন ঘোষণার পর পর সবার আগে স্যালনগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এমন অবস্থায় অড়াই মাস ধরে কর্মহীন হয়ে আছেন তিনি। দেশে টাকা পাঠানো দূরে থাক। এখন কবে চাকরি পাবেন সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তায় আছেন। খুঁজলে এমন অনেক কর্মীর দেখা মিলবে। দোকান বন্ধ মানে চাকরি নাই। মালিকেও খোঁজ খবর নেয় না। খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছি’।

Advertisement

উজ্জলের পাঠানো টাকার ওপর নির্ভর করে চলে দেশে থাকা তার পরিবার। গত আড়াই মাস কোনো টাকা না পাঠানোয় এই পরিবারটিও তীব্র অভাব অনটনের মুখে পড়েছে বলে তিনি জানান। ধার-দেনা করে চড়া মূল্য দিয়ে মালয়েশিয়া এসেছেন বলে জানান। দেনার অর্থ তার আয় থেকেই শোধ করতে হয়।

লকডাউনের পর মালয়েশিয়ায় থাকা এই শ্রমিকরা তাদের চাকরি ফেরত পাবেন কিনা, আবার যাদের চাকরি আছে তারা টিকে থাকতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নিলে এই মানুষগুলোর কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

শ্রমিকদের আয়ের ওপর নির্ভরর্শীল বাংলাদেশের পরিবারগুলো একধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী হারুন আল রশিদ বলেন, এই সংকটকালীন প্রবাসী অভিবাসীদের অনেক পরিবার দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যেতে পারে। সরকারের চলমান উদ্যোগের পাশাপাশি এদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে টাকা পাঠানোর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ফলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে গেছে এবং সাধারণ বাজার অর্থনীতিতে প্রবাসী পরিবারের কেনাকাটার ফলে যে অর্থ প্রবাহ ছিল সেটা সংকুচিত হয়েছে। সামনে ঈদ উল ফিতর, প্রতি বছরের ন্যায় এই ঈদে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠাতে সক্ষম হবে না। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

চলতি বছর বাংলাদেশে এই রেমিট্যান্সের হার ২২ শতাংশ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত এপ্রিল মাসে প্রবাসীরা যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন সেটা বিগত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এমতাবস্থায় প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলোর সহায়তার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার কথা জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মনিরুছ সালেহীন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের জন্য ২০০ কোটি টাকার একটি ঋণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় এই অভিবাসী শ্রমিকদের সহজ শর্তে ৪ শতাংশ সুদে এক লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হবে।

তিনি বলেন, ‘যে সকল কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে আসবেন এ সুবিধা পাবেন তাছাড়াও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে পুনর্বাসন লোন নিয়ে নিজে কিছু করতে পারবেন। এছাড়াও নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে ক্ষুদ্র শিল্প বা ব্যবসা করতে পারে এ জন্য সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক লোণ দিয়ে থাকে। সরকারের এ সকল পদক্ষেপের কারণে পরিবারের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে এমন আশাকরছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমআরএম/পিআর