পায়ের কাদামাটি পরনের কাপড়ে তো বটেই গায়ের এখানে সেখানে, এমনকি গালে-মাথায়ও লেগে থাকে। কৃষকের এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। অনাদিকাল ধরে বাংলার কৃষক এভাবেই এক গাল হেসে ফসলের খোঁজ দেন এমনভাবে, যেন বা তার সন্তানের কথা বলছেন। সন্তানের শরীরটা ভালো আছে কি নেই, তা যেমন বোঝা যায় বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, কৃষকেরও তাই। বাংলার কৃষক খেতের ফসলকে সন্তানের মতো ভালোবাসেন। পরম মমতায় বড় করে তোলেন। ফসল ভালো হলে গালভরা হাসি। ফসলের ক্ষতি দেখলে মুখ শুকিয়ে আসে।
Advertisement
২০২০ সালে বাংলার কৃষক কেমন আছেন, তার খোঁজ নেয়ার আগেই এসে পড়ে গোটা বিশ্বকে শাসিয়ে বেড়ানো এক মহাদুর্যোগ। এমনিতেই বৈশাখের আগে আগে বুক ধুকপুক করে। অসময়ে বৃষ্টি আসে কি না, আগাম বন্যা আসে কি না, মাঠে কাজ করার সময় আকাশ থেকে নেমে আসে কি না বাজ নামের মৃত্যুদূত, এ রকম নানান আপদবিপদের ভয়ে কৃষক দুই হাত আকাশে তুলে সাহায্য কামনা করেন। এ বছরও সে রকম ধুকপুকানি টের পেতে না পেতেই একদম অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরলো কৃষক-অকৃষক সবাইকে। মহামারির আতঙ্ক। সেই মহামইরর নাম কী, তা-ও জানা হয়ে যায়।
করোনাকে গাঁও-গেরামের বেটিছাওয়ার নাম করুনা বানিয়ে কৃষককুল ভ্যাবাচ্যাকা খান। করুনা নাকি মানুষকে ঘরের বাইরে পেলেই ধরে বসে। দূরে দূরে মানুষ থাকে, মুখে কাপড় বাঁধে, হাত দিয়ে কোনো কিছু ধরতেই ভয় পায়, এমনকি হাতের সাথে নিজের নাক-মুখেরও শত্রুতা তৈরি হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কৃষক কী করবেন, কী করবেন না, বুঝতে পারেন না। মাঠে বোরো ধান পেকেছে। ধান কাটবে কে? কাউকে পাওয়া যায় না। ঘর থেকে কে বেরুবে? করুনা বেটির ভয়ে পেটে পাথর বেঁধে পড়ে থাকবে? কদ্দিন? কৃষক ভাবেন, ক’টা দিন পরেই সমস্যার সমাধান হবে নিশ্চয়ই।
মানুষের খিদে পায়। মানুষগুলোকে ঘরে রাখাও খুব জরুরি। সরকারি চাল-ডাল-আলু পৌঁছে গেছে মানুষের ঘরে। তাই ধানের মাঠে কেউ আসে না। গনগনে রোদের নিচে চকচকে সোনা ধান বাতাসে নাচে। কৃষকের কপালে ভাঁজ পড়ে আরও বেশি।
Advertisement
তারপর একদিন দেবদূত হয়ে এই দেশের কত কত মানুষ চলে আসেন দলবল নিয়ে, কৃষকের ধান কেটে দেন।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হুকুমে নাকি ধান কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। মাঠের ধানের খবর জেনে তিনি চুপ করে বসে থাকেননি। বিপুল জনগোষ্ঠী না খেয়ে থাকবে না এবং এতে কৃষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়েছেন কৃষকদের। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি না থাকে, কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে দেশে যাতে খাদ্য সংকট না হয়, সে জন্য কৃষিখাতের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র চাষি ও খামারি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের সকল প্রকার সহযোগিতা দিতে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, স্বল্পসুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, কারিগরি সহায়তা এবং ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সরকার। পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল দাঁড় করানো হয়েছে। আগামী বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়বে।
কৃষক যাতে বোরো ধানের ন্যায্য দাম পায়, সে জন্য আগের চেয়ে দুই লাখ মেট্রিক টন বেশি বোরো ধান কেনা হচ্ছে সরকারিভাবে। তবে কৃষকের কি কেবলই ধান? আলু-পেঁপে-কাঁঠাল-আম, এ রকম আরও অনেক কিছু। ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হওয়া দরকার। মুনাফাখোর দালালরা ঠকায় কৃষককে, ঠকায় আমজনতাকে আর বোকা বানায় গোটা দেশকে। পেঁয়াজ গুদামজাত করে কি কৃষক? ফসলের দাম কৃষক ঠিকমতো পান না। ওদিকে ক্রেতা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন। মাঝখানে বিনা খাটুনিতে রমরমা ব্যবসা করে দালালরা।
Advertisement
খবরের কাগজের শিরোনাম যেন একই থাকে, বদলায় না। মহামারিতেও স্বভাব বদলায় না অমানুষদের। রোজা-রমজানেই বদলায় না, মুখে আল্লাহ-খোদার নাম নিয়ে মানুষ ঠকানো অমানুষরা মহামারিতেও দাঁত-নখে শান দিতে ব্যস্ত। ওদিকে সন্তান মানুষ না হলে বাবা-মায়ের যেমন কষ্ট হয়, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে বাংলার কৃষকের কষ্ট যেমন তেমনি। বুকভরা হাহাকার উড়ে যায় দখিনা বাতাসে, চোখে জমে ভরা বরষার গহিন গাঙ। গামছায় মুছে নেয়া দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই দেখেন, দেবদূত দলবল নিয়ে আবারও নেমেছেন পথে। ভ্যানে সাজানো কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেয়া সবজি। বিনা পয়সায় প্রয়োজন মতো সবজি নিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ার দিয়ে বারবার বলছেন, দেশে কোনো খাদ্যঘাটতি নেই। উদ্দেশ্যমূলক ঘাটতি তৈরি করলে রেহাই নেই কারোর। স্বভাব খারাপ যাদের, তাদের ভয়ডর কম। সংখ্যায়ও কম। কিন্তু এদের অপকর্মই তো মানুষের মনে হতাশা তৈরি করে বেশি। লকডাউনের অজুহাতে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে এদের দেরি হয় না। ওদিকে একই অজুহাতে কৃষককে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হতে করতে চায়। শাকসবজি পচনশীল বলে বিক্রি না করেও উপায় কী, কঠিন যুক্তি এদের। হতাশ কৃষক। হতাশ আমি-আমরা, যারা বেচারা ক্রেতা।
বাংলার কৃষককে হতাশ হতে হয়নি। ‘বন্ধু’ চিনে ফেলতে দেরি হয় কারো? আর চিনে ফেললেই তো হতাশা কেটে যায়। কৃষকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একের পর এক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, একদম ঠিক বঙ্গবন্ধুর মতো, একদম ঠিক সত্যিকারের বন্ধুর মতো। বাংলাদেশের সুখবর পেতে ভালোবাসেন যারা, তারা কৃষকের মতোই খুশির সাথে জেনে গেছেন ‘কৃষক বন্ধু ডাক সেবা’র কথা। প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত পণ্য রাজধানী ঢাকায় পাইকারি বাজারে বিনাখরচে চলে আসবে মাঝখানে থাকা অন্য কারোর সাহায্য ছাড়া।
কৃষক চিনে ফেলেছেন ডাক অধিদফতরের চালু করা ‘কৃষক বন্ধু ডাক সেবা’ নামের সেবাটি। প্রাথমিকভাবে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা বাজার থেকে কেজি কেজি শাকসবজি নিয়ে কৃষকরা এসে গেছেন এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, ঘরে বসেই কৃষক জানাবেন তার উৎপাদিত পণ্য কোন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হবে, মিনাবাজার, চালডাল আর পার্কিংবাজার অনলাইনে কৃষকদের সাথে যোগাযোগ করে সরাসরি পণ্য কিনছে এবং দেশব্যাপী ডাক পরিবহনে ব্যবহৃত রাজধানী ফেরত ডাক অধিফিতরের গাড়িগুলো ঠিক জায়গা থেকে সংগৃহীত কৃষিপণ্য ঢাকার গাবতলী কৃষিবাজার এবং ধানমন্ডির মিনাবাজারে পৌঁছে দিচ্ছে। কৃষক বিক্রয়লব্ধ পণ্যের ন্যায্যমূল্যের টাকা ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন। আমি-আমরা ন্যায্যমূল্যে পণ্য পেয়ে যাচ্ছি। লকডাউনে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার অসুবিধা কৃষককে এবং ভোক্তাকে বইতে হচ্ছে না, এর চেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে?
চমৎকার একটি ‘ইনোভেটিভ’ আইডিয়া, কিন্তু আগে থেকেই দেশব্যাপী ডাক পরিবহনের গাড়ির সেবা চালু থাকায় সরকারের অতিরিক্ত কোনো খরচ হচ্ছে না। খুব সহজেই দেশব্যাপী এই সেবা চালু করা সম্ভব এবং সরকার সেই কাজটিই করছেন। আসলেই কিন্তু ‘বন্ধু’ থাকলে আর কী লাগে? কথাটা বারবার প্রমাণিত হোক, বাংলার কৃষকের চাওয়া কেবল এটুকুই।
(একটি পিআইডি ফিচার)
এইচআর/বিএ/জেআইএম