আল্লাহ তাআলার ফজলে নাজাতের দশকের রোজা রাখার তাওফিক পাচ্ছি, আলহামদুলিল্লাহ। আমরা জানি, রমজানের দিনগুলোতে আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঝড়ো গতিতে দান-সাদকা করতেন। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন রমজানে দান-সাদকা করেন কিন্তু যে হারে করা প্রয়োজন সেভাবে হয়তো করেন না।
Advertisement
শুধু রমজান মাস আসলেই কিছু মানুষকে দেখা যায় জাকাতের কাপড় বিতরণ করতে, যদিও এটি ইসলামি পদ্ধতি নয়, জাকাতের অর্থ জমা করতে হয় রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালে তথা জাকাতের জন্য নির্ধারিত তহবিলে।
আমরা যেভাবে নামাজ আদায় করাকে ফরজ জানি তেমনি জাকাত প্রদানও ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর একটি। পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা নামাজের পাশাপাশি জাকাত প্রদানের নির্দেশও দিয়েছেন। নামাজের সঙ্গে সঙ্গে জাকাতের সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
সংগতিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে জাকাত ব্যতিত নামাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মূলত নামাজ ও জাকাত ব্যতিত ইসলামী জীবন গঠনই অসম্ভব। জাকাত আদায়ে বিরত থাকা ব্যক্তি সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনায় কঠিন শাস্তির বর্ণনাগুলো এভাবে এসেছে-
Advertisement
- ‘যারা স্বর্ণ রৌপ্য মজুদ করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, হে নবি! তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ এবং পিঠকে সেক দেয়া হবে (এবং তাদের বলা হবে) এটা তার প্রতিফল যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। সুতরাং তোমাদের ধনভাণ্ডারের শাস্তি আস্বাদন কর।’ (সুরা আত-তাওবাহ : আয়াত ৩৪-৩৫)
- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার জাকাত আদায় করে না, উক্ত মালকে কেয়ামতের দিন তার জন্য বিষধর সাপে পরিণত করা হবে। যার চোখের ওপর কালো দাগ পড়ে গেছে। অতপর তা স্বীয় চোয়ালদ্বয় দ্বারা তাকে কামড় মারবে এবং বলবে আমি তোমার ধনভাণ্ডার, আমি তোমার মাল।’ (বুখারি)
প্রকৃত পক্ষে জাকাত আদায়ই সম্পদ ও ব্যক্তিকে পবিত্র করে। যেভাবে আল্লাহ পাক বলেন-‘তাদের মালামাল থেকে জাকাত গ্রহণ কর, যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে।’ (সুরা আত-তাওবাহ : আয়াত ১০৩)
পৃথিবীর বুকে মানুষ যাতে সুখে শান্তিতে সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারে তার জন্যই দয়াময় আল্লাহ তাআলা জাকাতের ব্যবস্থা করেছেন। শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির নামই ইবাদত নয়। সংসারে জন্মগ্রহণ করে সংসারধর্ম রক্ষা করে, সত্য ও সঠিক পথে চলে মানবজীবনের প্রতিটি কর্মই ইবাদতের মধ্যে শামিল।
Advertisement
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজানের পর নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে মসজিদে আগমন করতেন এবং সমবেত মুসল্লিগণের সাথে বসতেন এবং উপস্থিত অনুপস্থিত প্রত্যেক মুসলিম ভাই বোনদের খোঁজ-খবর নিতেন ও প্রত্যেকের জাগতিক সমস্যার সমাধান করতেন।
কিন্তু আজ আমরা কী দেখি, আমার পাশের ঘরের মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করলেও আমি তার কোনো খবর রাখছি না। বর্তমান করোনাকালীন সময়ে কত পরিবারই না কষ্টে দিনাতিপাত করছেন কিন্তু তাদের জন্য আমি কিবা করেছি। সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
ইসলাম শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয় নাই। বাস্তব জীবনে জাকাতকে ফরজ কার্যের আওতায় এনে প্রতিফলনও ঘটিয়েছে। জাকাত দ্বারা দরিদ্র জনসাধারণের জন্য একটি চিরস্থায়ী দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাতীয় দৈন্য দুর্দশার মুক্তি সাধনায় বহু ত্যাগ স্বীকার করে তিনি বায়তুল মালকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে মুসলমান জাতির প্রাণশক্তি ছিল বায়তুল মাল। তখন জাকাত আদায় করার জন্য আদায়কারী নিযুক্ত ছিল। তারা নিয়মিত জাকাত আদায় করে বায়তুল মালে জমা দিতেন এবং তা থেকে দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে যথাযথ নিয়মে তা বণ্টন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারকল্পে ব্যয় করা হতো।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় সাহাবাদের অনেকেই ছিলেন দরিদ্র ও অভাবী। নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে তারা বহু অভাব অনটনে থাকা সত্বেও আল্লাহর পথে দ্বীনের কাজের জন্য বহুবিধ পথে তারা সম্পদ ব্যয় করতেন। এ সব সাদাকাতের মধ্যে জাকাত ছিল অগ্রগণ্য ও সর্বব্যাপী।
সব জিনিসের ওপর জাকাতের একটি অংশ বরাদ্ধ ছিল। উৎপাদিত ফসলের ওপর, বানিজ্য পণ্যের ওপর, ঘোড়া, উট ও গবাদি পশুর ওপর, বাগ-বাগিচাসহ সব সম্পদের ওপরই জাকাতের নির্দেশ আছে। তাদের দরিদ্র ও অভাব সত্বেও কখনো কোনো নির্দেশে তারা আপত্তি তোলেন নি। অধিকন্তু পরম আন্তরিকতা ও উদারতার সঙ্গে জাকাত ও দান-সাদকা করে গেছেন।
বর্তমান যুগে অনেকের কাছেই বহু অর্থ-সম্পদ রয়েছে কিন্তু জাকাতের প্রতি কোনো মনোযোগ নেই। ভাবনা চিন্তাও নেই। এছাড়া জাকাত আদান প্রদানের সঠিক তেমন কোনো বায়তুল মালের কার্যকরী ব্যবস্থাও দেখা যায় না।
পবিত্র এ মাহে রমজানে আমাদের বেশি বেশি নামাজ আদায়ের পাশাপাশি জাকাত প্রদানে সোচ্চার হয়ে অসহায়দের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা যদি আল্লাহর হক এবং বান্দার হক সঠিকভাবে আদায় করি তবেই আল্লাহ তাআলার জান্নাত লাভে সক্ষম হবো। আল্লাহ তাআলা যেভাবে বলেছেন, জাকাত প্রদানের মাধ্যমে আমাদের সম্পদকে তিনি পবিত্র ও বরকতময় করবেন।
তাই আসুন, রমজানেই আমাদের ধন-সম্পত্তির হিসাব করে জাকাত প্রদান করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাকে সম্পদের সঠিক হিসাব করে জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। জাকাত আদায়ে রমজানই হোক নিজেদের সম্পদ ও জীবনকে পবিত্র করার মহাসুযোগ। আমিন।
এমএমএস/পিআর