‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানাসত্য কাজে কেউ নয় রাজিসব দেখি তা না না না....গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয় লালন বলে জাত কারে কয় এই ভ্রমও তো গেল না’অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে ফকির লালন সাঁই রচিত বিখ্যাত গান। লালনের এ গানের মধ্য দিয়েই যেন তিনি তার আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন জাত-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানব ধর্ম এবং মানব সেবা মানেই আত্মসাধনা। আর আত্মসাধনার মধ্য দিয়েই পরমাত্মার দর্শন মেলে। লালন কখনও ধর্মের বড়াই করেননি। এমনকি তার ধর্ম পরিচয় কি ছিল, তা কখনো শিষ্যকূলে বলে যাননি। লালনের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝেও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। জানা যায়, লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনকালে তিনি হিন্দু ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, যার প্রমাণ মেলে তার রচিত গানে। লালন সাঁইজির ১২৫ তম তিরোধান উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে চলছে লালন স্মরণোৎব। স্মরণোৎসবের মূল আকর্ষণ লালন সাঁই রচিত শত শত গান। লালন একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে লালন সংগীত পরিবেশন হয় মূল মঞ্চে। লালন একাডেমির বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শিল্পী, ফকির, বাউল, সাধকরাও এখানে গান পরিবেশন করে থাকেন। গান চলে সাধন কুঞ্জগুলোতেও (আসর অথবা বৈঠক)। এমন কুঞ্জে সবাই শিল্পী, সবাই যেন দোহারী। সাধক, ভক্ত, শিল্পীদের সুরে সুরে গোটা মেলা চত্বরই হয়ে যায় গানের মঞ্চ। আখড়াবাড়ির কাছে যেতেই মাইকে ভেসে আসে লালনের মর্মবাণী। যে বাণীতে মরমী কবি বাউল সম্রাট লালন সাঁইজি আত্মা-পরমাত্মার সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন। সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/, আমি অপার হয়ে বসে আছি/, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি/, জাত গেলো জাত গেলো/, আপন ঘরের খবর লে না/, আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী/, মন তুই করলি একি ইতরপানা/, এই মানুষে সেই মানুষ আছে/, যেখানে সাঁইর বারাম খানা/, বাড়ির পাশে আরশিনগর/, আমার আপন খবর আপনার হয় না/, দেখ না মন ঝাক মারিয়ে দুনিয়াদারী/, ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফান্দ পেতে/, সব সৃষ্টি করলো যে জন/, সময় গেলে সাধন হবে না/, কে বানাইলো এমন রঙমোহল খানা/, আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে/, তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে/, মিলন হবে হবে কত দিনে, এমন হৃদয় স্পর্শ করা শত শত গানে মুগ্ধ সাধক-দর্শকরা। গোটা মেলা চত্বরই যেন গানের মঞ্চ। দর্শকেরা হেঁটে হেঁটে গাইছেন, সাধকেরা বসে বসে গাইছেন। লালনের করা সুরে, দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে শিল্পীরা সর্বোচ্চ আবেগের প্রকাশ ঘটিয়ে মন মাতাচ্ছেন। গানের তালে শিল্পী-বাদকরা সমানতালে নাচছেন। নাচছেন ভক্ত-আশেকান, খ্যাপা-খ্যাপিরাও। কেউ আবার গান শুনেই দু’নয়ন জলে ভাসাচ্ছেন। গানে তাড়িত হয়ে শিষ্যরা ভক্তি ভরে প্রণাম করছেন গুরুকে, গুরু বুকে জড়িয়ে ধরছেন শিষ্যকে। লালন গান যেন বসিয়েছে গুরু-শিষ্যের এক মহামেলা। এ যেন এক আজব লীলা। সাধক লাল্টু শেখ বলেন, মহাত্মা লালনের গানকেই আমরা বিধান মনে করি। সাঁইজির কালাম সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্মিলন ঘটিয়েছে। মানবের ঊর্ধ্বে কিছু নেই। সাঁইজি বলেছেন-‘মানুষ ছাড়া খ্যাপারা তুই মূল হারাবিমানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হবি’মেলার তৃতীয় দিনের মূল আকর্ষণ ছিল লোকশিল্পী কাঙ্গালিনি সুফিয়া। গুণী এ শিল্পী জাগো নিউজকে বলছিলেন, মনের টানে আসি। দাওয়াত করলেও আসি, না করলেও আসি। এই মেলায় এসে যে প্রাণ পাই, তা পৃথিবীর কোথাও মিলবে না। লালন আমার প্রাণপুরুষ। লালনের দেখানো পথে চলতে পারলে হিংসা-বিদ্বেষ থাকে না। জাতের গৌরবে মুক্তি মেলে না, তা সাঁইজি সহজ ভাষায় বলে গেছেন। সাঁইজি কয়-‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে যেদিন হিন্দু মুসলামান বৌদ্ধ খ্রিস্টানজাতি গোত্র নাহি রবে।’ এএসএস/এএইচ/পিআর
Advertisement