মতামত

মহামারির সময়ও যুদ্ধবিরতি হবে না!

কোভিড-১৯ নামের যমদূতের বাহক ভাইরাস ঠেকাতে ব্যস্ত সবাই। এই ভাইরাসও ব্যস্ত। মানুষ মারছে, সাথে মারতে চাইছে মানুষের অমানবিক অভ্যাস, ভণ্ডামি, যুদ্ধস্পৃহা- এ রকম অনেক কিছু। মানুষ মরছে, কিন্তু এ রকম অনেক কিছুর অনেকটাই মরে গেছে না ঝিম মেরে আছে, তা বুঝতে সময় লাগবে আরও। আচ্ছা, সত্যিই কি পৃথিবীর সবকিছু ঠিকঠাক পথে এসে যাবে? মানুষ বাঁচবে সবাইকে নিয়ে? যুদ্ধ হবে না? শান্তির সুবাতাস বইবে? বইবে তো?

Advertisement

আল্লা-ভগবান-ঈশ্বর-গডকে ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের প্রায় সব মানুষের। সৃষ্টিকর্তার পাঠানো শাস্তি না মানুষের বানানো মানুষ-মারার অস্ত্র ভাইরাসটি, তা নিয়ে আলোচনার ঝড় ঝগড়ায় পরিণত হয়ে বিশ্ব মোড়লদের ফেলে দিয়েছে দারুণ চিন্তায়। মানুষ বাঁচাতে বুক পেতে দেয়া চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানালেও ব্রিফকেস নিয়ে ছোটাছুটি চলছে ভ্যাকসিন নামের সোনার খনি কার হাতে আগে আসবে, তা নিয়ে।

যেখানে ব্যবসা নেই, সেখানে কোনো কথা নেই। আর তাই প্লাজমা চিকিৎসায় মানুষের প্রাণ বাঁচলেও এ যেহেতু অলাভজনক মানবিক ব্যাপার-স্যাপার, এ নিয়ে কোনো বিজ্ঞান জার্নালেও দু-কলম খুঁজে পাওয়া মুশকিল, বাঘা বাঘা মুরব্বিরা টু শব্দটিও করছেন না। ভাগ্যিস বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের আশায় হাপিত্যেশ করে মানুষকে মরতে না দিয়ে মানুষ বাঁচানোর জন্য প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা থেকে শুরু করে যাবতীয় লৌকিক চিকিৎসার পাশাপাশি এ দেশের চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ ঠেকানোর জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। সম্ভবত করোনা প্রতিরোধে ‘বাংলাদেশ মডেল’ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তবে মানবিক এই যুদ্ধ বিশ্ব মিডিয়ার কতটুকু আলো পাবে বলা মুশকিল।

আশাবাদী হতে চাই। নিশ্চয়ই পৃথিবী বদলাবে। যুদ্ধ থামবে। করোনা মহামারি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে মহান শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, তার ফলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলো যুদ্ধাস্ত্র বানানো থামাবে। তারা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের উপকারে আসতে চাইবে। মানুষের পুষ্টিগত অবস্থানকে উন্নত করে তুলতে একযোগে কাজ করবে। আগামী পৃথিবীর যুদ্ধ হবে ভাইরাস ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে নয় কিছুতেই।

Advertisement

আশাবাদী হতে পারছি কি?

জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল খুব চেষ্টা করছিল কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে একটি যৌথ সম্মতিপত্র উপহার দিতে, যেখানে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ মর্মে দেশগুলো এক হয়ে সম্মতি জানাবে। মহামারিকালে বিশ্বের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এ হতে পারত এক বিনম্র প্রচেষ্টা। দুই মাস ধরে চেষ্টা করছে কাউন্সিলের সদস্য ১৪টি দেশ। হয়নি। গত ১৫ মে কাউন্সিলের ১৫ সদস্যের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে সম্মতিপত্রের প্রস্তাব। পিছিয়ে গেছে বাকিরাও। আর সমঝোতা হবে বলে মনে হচ্ছে না।

গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরাস অনুরোধ করেছিলেন এ রকম একটি সম্মতিপত্রের, যাতে করোনাভাইরাসের আক্রমণে পর্যুদস্ত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দ্বন্দ্বমুখর এলাকাগুলোতে সাহায্যকর্মী এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রত্যেকের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়। ফ্রান্স এবং তিউনিসিয়ার তৈরি করা খসড়া সম্মতিপত্রে নব্বই দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব রাখা হয়েছিল।

মহামারিকালে সন্ত্রাসের সাথে লড়াই না করে সবাই মানুষের প্রাণ বাঁচানোর লড়াইয়ে শামিল হওয়া জরুরি, এটাই ছিল কাউন্সিলের মূল এজেন্ডার ভাবার্থ। দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া আর লিবিয়ার মতো দেশগুলোর ভঙ্গুর অর্থনেতিক অবস্থায় এ রকম হওয়াটা খুব জরুরি ছিল। কলোম্বিয়া, ফিলিপাইনে ত্রাণ দিতে যাওয়া সাহায্যকর্মী এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী চিকিৎসকরা বিপদে পড়েছেন। এ কারণে মার্চ মাস থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব সোচ্চার হতে বাধ্য হলেও প্রয়োজনটা অনুভূত হচ্ছিল আরও আগে থেকে। চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াই থামিয়ে দিচ্ছিল প্রচেষ্টা।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) মহামারির তীব্রতা ও ভয়াবহতা নিয়ে জোরালো বক্তব্য রাখতেই প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে জোর চেষ্টা চলছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হু’র বিষয়ে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। চীনের ঘাড়ে দোষ কেন দেয়া হচ্ছে না, এই অজুহাত তুলে সরে যেতে চাওয়ার খুব অল্প সময়ের ভেতর মার্কিন অনুদান বন্ধ করার মতো পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। চীন এখনও সবার সামনে কিছু না বললেও ভবিষ্যতে যে বলবে না, তা তো না-ও হতে পারে।

সবকিছুতে লকডাউন চলছে। যুদ্ধে কেন চলবে না? ফ্রান্স প্রথমে ভেবেছিল এভাবে। মহামারির প্রকোপ ফ্রান্সে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল, দেশটি তা প্রতিরোধে ব্যস্ত হলেও মহতী এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করেছে। মার্চ মাসেই নিরাপত্তা কাউন্সিলের অন্য চার স্থায়ী সদস্য দেশের সাথে সাধারণ আলোচনা করে। সেই সময়ে মার্কিন পক্ষ জোরালো দাবি জানায় সম্মতিপত্রের বাক্যে স্পষ্টভাবে লেখা থাকতে হবে, এই ভাইরাসের উৎস চীনের উহান শহর। চীন বারবার প্রত্যাখ্যান করায় কাউন্সিলের সদস্য দেশগুলো পড়ে যায় বদ্ধ গলির শেষ মাথায়। এরপরও খসড়া সম্মতিপত্রের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছিল, যদি আলোচনার পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই আশায়।

খসড়া সম্মতিপত্র তৈরি করতে গিয়ে করোনাকালীন অনেকগুলো ইস্যু সামনে চলে আসে। তিউনিসিয়া হু’র ভূমিকার প্রশংসা করে মহামারির কারণে বিশ্বের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কি প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে জোর আলোচনার দাবি জানায়। অন্য নির্বাচিত সদস্যরা অবশ্য তিউনিসিয়ার দাবি মূল আলোচনা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে আনতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকা যেমন বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার উন্নয়নকে মূল লক্ষ্য হিসেবে দেখতে আগ্রহী, আর্থসামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরবর্তীতে ভাবা যেতে পারে বলে মতামত দেয়। আমেরিকা আর রাশিয়া যার যার দখলে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর বিষয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছিল। তবে মোটের ওপর সবাই যুদ্ধবিরতির সাধারণ প্রস্তাবে বিরোধিতা করেনি।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এসে ফ্রান্স আর তিউিনিসিয়া একটি যৌথ প্রস্তাব দাঁড় করায়, যেখানে যুদ্ধবিরতির সুস্পষ্ট দাবি থাকলেও অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রস্তাব, মানবাধিকার অক্ষুণ্ন রাখা বিশেষ করে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি বৈষম্য চরম হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট ও সুপরিকল্পিত কোনো প্রস্তাবের উল্লেখ ছিল না। ফলে জাতিসংঘের সমঝোতার প্রতি দৃষ্টি রাখা যুদ্ধংদেহী পক্ষগুলো ‘কাগুজে’ বলে পাশ কাটিয়ে আবারও ফিরে গেছে হানাহানিতে। কোথায় কোথায় রক্ত ঝরছে, সে তথ্য পেতে গুগল বরাবরের মতো খুব সাহায্য করছে।

এর মানে কী? ফ্রান্স-তিউনিসিয়ার প্রস্তাবটি কেবলমাত্র অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারণার কারণে ঝুলে গেল, কেননা জাতিসংঘ এর প্রেক্ষিতে সবাইকে একমত করতে ব্যর্থ হলো! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস-স্থান সম্বন্ধে ‘অস্বচ্ছ’ তথ্য দেয়ার অভিযোগে সরে দাঁড়ানোর মাধ্যমে চীনকে বেইজ্জতি করার জোর চেষ্টা হলো। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে কোনো আলাপে যাবেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, কেননা অনুদান বন্ধ করে দেয়ার ফলে এ বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে গেছে বলে আওয়াজ দেয়া হয়ে গেছে।

চীন অবশ্য হু বিষয়ে আমেরিকার সাথে সমঝোতার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, জাতিসংঘের সাথে এক হয়ে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সম্মতি দিয়েছে। আমেরিকান পক্ষ স্বচ্ছতার প্রসঙ্গটি তুলে নিতে নিমরাজি মনে হলেও ফ্রান্স আর তিউনিসিয়া যখন চূড়ান্ত রেজুলেশন সবার হাতে পাঠিয়ে দেয়, একেবারে শেষ সময়ে এসে আমেরিকা তার আপত্তির কথা জানিয়ে প্রত্যাখ্যান করে এটি। গুজব উড়ছে বাতাসে। সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেও মহামারি ঠেকাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে এসব লুকাতে চীনকে কদিন ধরে খুব আক্রমণ করছেন এবং তিনিই নাকি শেষ মুহূর্তে বাগড়া দেন।

হতাশ না হয়ে জার্মানি এবং এস্তোনিয়া রেজুলেশনের কথাগুলো ঠিকঠাক করতে কাজ শুরু করেছে। এখন চীন এটা মানবে কি না, সে প্রশ্নে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে কেবল যুদ্ধবিরতির বিষয়টি রেখে রেজুলেশন দাঁড় করানো হলেও চীন আর আমেরিকা এতে আগ্রহ দেখায়নি, সহযোগিতার সত্যিকারের ইচ্ছের অভাবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে এতে। ফলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যদের মাঝে আস্থাহীনতার সংকট আরও গাঢ় হচ্ছে।

শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক বিপর্যয়ে মানুষ বাঁচানোর স্বার্থে সোজাসাপ্টা যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব পাশ করাতে জাতিসংঘের সবচেয়ে শক্তিশালী নীতিনির্ধারক অংশটি যদি এভাবে নাকানি চুবানি খায়, তাহলে বিপর্যয়ের আকার আরও বেড়ে উঠলে কী হবে? মহাশক্তিধর দেশগুলোর টানাপোড়েনের মাঝে সুযোগ নেবে যুদ্ধবাজ পক্ষগুলো। এর প্রভাব নদীর পানির মতো গড়াতে গড়াতে এসে পড়বে সব মানুষের ঘরের দোরে, তখন জাতিসংঘ কীভাবে বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হবে, তা সত্যিই ভাববার বিষয়।

এইচআর/বিএ/জেআইএম