ধর্ম

ঈদুল ফিতরের প্রকৃত আনন্দ

সিবগাতুর রহমান

Advertisement

মাহে রমজান প্রায় শেষ দিকে। পবিত্র একটি উপলক্ষ ঠিক আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ছোটবেলায় স্কুলের কোনো এক শ্রেণির 'আমার বই-এ পড়েছিলাম ‘নবিজীর প্রেম’। তাতে লেখা ছিল-‘আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে ছেলে মেয়েদের কলরব। দলে দলে লোক ঈদগাহে যাচ্ছে। নামাজ পড়ছে, কোলাকোলি করছে। এমন সময় নবিজী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলেন ঈদগাহের এক কোণে বসে একটি ছেলে কাঁদছে। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাছে গেলেন, তার কষ্ট শোনলেন, তাকে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাড়িতে নিয়ে নতুন জামা-কাপড় ও খাবার দিয়ে ছেলেটির দুঃখ দূর করার চেষ্টা করলেন।'

আমাদের দেশেও একটি অংশ রয়েছে যাদের কাছে ঈদা-আনন্দ মানেই হলো বেঁচে থাকার লড়াই। দু'বেলা খাওয়ার সংগ্রাম। আজো রয়েছে দুঃখী ছেলেদের ভীড়। কিন্তু নবিজীতো (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নেই তাদেরকে কোলে তুলে নেয়ার জন্য।

আমরা কি পারিনা- তাদের দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করতে। তাদের মুখে একটু হাসি ফোঁটাতে। নতুন পোশাক, সুস্বাদু খাবার বা ঈদের অন্য আনন্দগুলো তাদের সাথে ভাগাভাগি করতে।

Advertisement

আসুন না, একটিবার ভাবি- সেসব অসহায় ও দুঃখী মুখগুলোর কথা, যাদের সাধ্য নেই একটি নতুন পোশাক ও সুস্বাদু খাবার কেনার। একবার ভাবি সেসব অসহায় পথশিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষরে কথা, যারা বঞ্চিত ও অবহলেতি। আসুন না, হাসি ফোঁটাই এসব অসহায় মানুষগুলোর মুখে। এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি তে এতগুলো দুঃখি মানুষকে পাশে রেখে আমরা কি পারবো আনন্দে কাটাতে।

প্রতি বছর দুইটি ঈদ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দের বন্যা। কিন্তু প্রতিটি মুসলমানের মন ও মননে ঈদুল ফিতরের আনন্দ ও প্রভাব অনেক বেশি। পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার পর এই উৎসব মুসলিম জাতির প্রতি সত্যিই মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে অনেক বড় নেয়ামত ও পুরস্কার।

এদিনে প্রতিটি মুসলমানের প্রেম, ভালবাসা, মমতা, আবেগ, অনুভূতি যেন ঈদের পবিত্র ও অনাবিল আনন্দে বিলীন হয়ে যায়। ঈদ আমাদের জীবনে শুধুমাত্র আনন্দ-উৎসবই নয়, বরং এটি একটি মহান ইবাদাত দিন। যার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা খুঁজে পায় এবং সব শ্রেণি-বয়সের নারী-পুরুষ ঈদের জামাতে শামিল হয়ে মহান প্রভুর শুকরিয়া আদায়ে সেজদায় নত হয়।

আজ আমাদের মাঝে এই আত্মজিজ্ঞাসা উত্থাপিত হওয়া প্রয়োজন যে, সত্যিই কি এই ঈদ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হবার কারণ হতে পেরেছে? আমরা কি ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই ভাই-ভাই হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই আনন্দ উদযাপন করছি?

Advertisement

যে মহান আল্লাহ আমাদের এই আনন্দের অনুমোদন দিয়েছেন, আমরা কি জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদা তাঁকে স্মরণে রেখেছি? আমরা কি প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত হিসাবে ঈদ পালন করছি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য সব সুন্নাতের অনুসরণ কি আমরা করছি?প্রতি ঈদেই সবাই সাধ্যানুযায়ী নতুন-নতুন, সুন্দর-সুন্দর পোষাক কিনে থাকেন। আমরা কি কখনো ভাবি সেসব অসহায় ভাই-বোনদের কথা, দারিদ্রের কষাঘাতে যাদের জীবন জর্জরিত। নতুন পোষাক কেনা দূরে থাক, পুরানো কোনো ভাল পোষাকও তাদের নেই। বরং প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানও তাদের নেই। আমরা যারা স্বচ্ছল তারা কি সামান্যতম হাসিও এদের মুখে ফোটাতে পারি না?

আনন্দ উৎসবের এ দিনে আমাদের সেসব হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কথাও স্মরণ করা উচিত, মৃত্যু যাদেরকে এ জগত থেকে না ফেরার জগতে নিয়ে গেছেন। সেখানে তারা দুনিয়ার জীবনে করে যাওয়া নিজেদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন। এই দিনে তাদেরকে ভুলে না গিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা।

ঈদ উৎসব পালনকালে সেসব স্বজনদের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা কঠিন অসুস্থতায় বাড়ি কিংবা হাসপাতালে দিনাতিপাত করছে। ব্যথা, যন্ত্রণা ও মানসিক পীড়নে ঈদের আনন্দ তাদের মাটি হয়ে গিয়েছে।

আল্লাহ যে সুস্থতা ও নিরাপত্তার অশেষ নেয়ামতের উপর আমাদের রেখেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা এবং এ সব রোগাক্রান্তদের আরোগ্য লাভের জন্যে দোয়া করা। সম্ভব হলে অসুস্থ স্বজন-প্রতবেশির সেবা-যত্ন করা।

আমাদের সবার এ দোয়া করা উচিত যে, নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাত অনুযায়ী আমরা যেন সাধ্যানুযায়ী গৃহহীন, বিধবা, ইয়াদিম, বিপদগ্রস্ত ও দুঃখী মানুষের সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারি।

এ রমজানে আল্লাহ তাআলা আমাদের অনেককেই রোজা রাখা, দান করা ও কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর ইবাদাত পালনের সামর্থ্য দিয়েছেন। কিন্তু ইবাদাতের এ ভরা মৌসুমেও আমাদের এমন অনেক ভাই-বোন রয়েছেন, যারা পাপের সাগরে নিমজ্জিত। দুনিয়ার জীবনের মরিচিকাসম তামাশায় মগ্ন হয়ে হয়তো জীবনের প্রকৃত কর্তব্য ভুলে গিয়েছে। আমরা কি পথহারা এসব আপনজন আল্লাহ তাআলার সরল পথের দিকে আহ্বান করতে পারি না? মহান রাববুল আলামিনের কাছে এদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করেছি? পবিত্র ঈদুল ফিতর এসব প্রশ্নের সুন্দর জবাব খুঁজে পেতে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।

পবিত্র মাস রমজান ছিল মূলতঃ আমাদের জন্য তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ লাভের মাস। সব ইবাদাত-বন্দেগিতে অভ্যস্থ হওয়ার মাস। ঈমান-আমল মজবুত করার মাস। নিজের নফস তথা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্রে বিভূষিত হওয়ার মাস।

কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করে জীবনকে সর্বক্ষেত্রে কুরআনমুখী করার মাসও এটি। মাসব্যাপী আমরা যারা নিজেদের এভাবে পরিচালনার জন্য চেষ্টা করেছি, মাসটি অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে যদি তা ভুলে যাই এবং আাল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য থেকে দুরে সরে যাই, তাহলে তা কুতটুকু সঙ্গত হবে? মূলতঃ যারা ভাবে যে, রমজান মাসে ইবাদাত করাই যথেষ্ট, তাদের সে ভাবনা অসঙ্গত ও ভুল। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদাত করতে থাক।’ (সুরা আল-হিজর : ৯৯)

তাছাড়া বিশ্বব্যাপি মহামারি করোনার কারণে এবারের ঈদ উৎসব এক ভিন্ন আমেজ পালন করতে হবে। ইতিমধ্যেই রমজানের দিনগুলো কাটছে কোনো প্রকার আড়ম্বর ছাড়াই। ইফতার পার্টির দৌড়ঝাপ নেই। ফুটপাতে ইফতারি বেচাকেনার পসরা সাজানো নেই। ছোট-বড় বিপনিবিতানগুলোতে দেখা যাচ্ছে ক্রেতাহীন শূন্যতা।

এ পরস্থিতিতে পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা ও সাহায্য র্প্রাথনার মাধ্যমে দিনগুলোকে সাজিয়ে তুলবো। এটাই হোক আমাদরে এবারের ঈদরে নতুন সংযোজন।

উল্লেখিত আলেচনার আলোকে আমরা যদি কর্তব্য কাজে তৎপর হতে পারি তবেই আমাদের ঈদুল ফিতরের এ আনন্দ-উৎসব অর্থবহ ও সার্থক হবে। ঈদুল ফিতরের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পারবো আমরা। ঈদ হোক সবার জন্য আনন্দের, সবাইকে ঈদ মোবারক ...

লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক, সিএস প্রশাসন (ক্যান্টিন ও ক্যাটারিং), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

এমএমএস/এমকেএইচ