আওয়ামী লীগাররা সবসময় বলে, শেখ হাসিনাই শেষ ভরসা। তাদের একটি খুব প্রিয় স্লোগান 'শেখ হাসিনার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ'। তাদের এই অতি শেখ হাসিনা নির্ভরতাটা আমার ঠিক পছন্দ নয়। একটা গণতান্ত্রিক সরকারের এতটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া ঠিক শোভন নয়। এই অতি শেখ হাসিনা নির্ভরতা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অথর্ব ও জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। তারা বুঝে গেছেন, তাদের আর জনগণের কাছে যেতে হবে না। নির্বাচন এলে শেখ হাসিনা পাস করিয়ে দেবেন। তাই তারা সুযোগ পেলে দুর্নীতি করেন, নিজেরা মারামারি করেন; কিন্তু জনগণের জন্য কিছুই করেন না।
Advertisement
সাধারণ মানুষও বিষয়টি জানে। তাই তারাও সবকিছুতে শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে। খাদ্যের জন্য খাদ্যমন্ত্রী নয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, এমপিওভুক্তির দাবি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নয়; সব দাবি, সব আবদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এ আমাদের এক অসম্ভব চাওয়া। কিন্তু এক যুগ ধরে শেখ হাসিনা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেছেন। বিশাল মন্ত্রিসভা আছে, বিশাল আমলাতন্ত্র আছে। কিন্তু কাজ সব শেখ হাসিনাকে একাই করতে হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুর জন্য চকলেট পাঠানো, প্রিয় গায়িকার জন্মদিনে টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে ফোন করে উইশ করা থেকে শুরু করে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জোটের দলের ঝামেলা, এমনকি মূল বিরোধী দলের মহাসচিবের চিকিৎসার তদারকিও তিনিই করেন। তিনি অর্থনীতি বোঝেন, জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতি বোঝেন, কূটনীতি বোঝেন। সব সামলান এক হাতে। আসলে তাঁর হাত যেন দুটি নয়, তিনি যেন শতভূজা। তাঁর সাফল্যের তালিকা অনেক লম্বা। কিন্তু ব্যর্থতার তালিকার ওপরের দিকেই থাকবে একটি দক্ষ ও ভাইব্র্যান্ট মন্ত্রিসভা গঠন করতে না পারা। একটি জনবান্ধব, দেশপ্রেমিক কর্মীবাহিনী বানাতে না পারা।
শেখ হাসিনার অনেক সমালোচনা আছে। গত একযুগে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারেরও নানান ব্যর্থতা আছে। কিন্তু আমি ব্যক্তি শেখ হাসিনার কর্মস্পৃহা দেখে বিস্মিত হয়ে যাই। ৭৩ বছর বয়সী একজন মানুষ দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত, সবচেয়ে কর্মক্ষম, সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করা মানুষ। সবচেয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কিছুই ভোলেন না তিনি। তাঁর যেন হাজারটা চোখ। কোনোকিছুই তাঁর নজর এড়ায় না। আগে আমিও শেখ হাসিনার এই একক কর্তৃত্বের সমালোচক ছিলাম। আমি চাইতাম, সবাই নিজ নিজ দায়িত্বটা পালন করুক। তাতে শেখ হাসিনা আরও নির্ভার থাকতে পারবেন, আরও বেশি করে দেশ নিয়ে ভাবতে পারবেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পলিসি ইস্যুতে সময় দিতে পারবেন। কিন্তু করোনার এই সময়ে আমার বিশ্বাস হয়েছে, শেখ হাসিনাই আসলে শেষ ভরসা। তাঁর কোনো বিকল্প নেই।
এই বিশ্বাস আমার আরও বেশি দৃঢ় হয়েছে করোনা মোকাবিলায় তাঁর বহুমুখী চিন্তা, অসম্ভব উদ্যম আর সৃষ্টিশীল সব উদ্যোগ দেখে। একজন কট্টর বিএনপিপন্থী চিকিৎসক দুদিন আগে বলছিলেন, এই সময়ে শেখ হাসিনা যেভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এরচেয়ে ভালোভাবে আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর আগেও বিএনপির অনেক নেতার কাছেও প্রশ্ন করেছি, আচ্ছা, বলুন তো এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো বিকল্প কে আছে? আওয়ামী লীগ সরকারের হাজারটা সমালোচনা করা মানুষটিও প্রশ্ন শুনে আমতা আমতা করেন। আপনি যতই আওয়ামী বিদ্বেষী হন, শেখ হাসিনার যত বড় সমালোচকই হন; এটা মানতেই হবে, এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই।
Advertisement
একটু দেরিতে হলেও আমিও এই বিশ্বাসে আস্থা রেখেছি করোনা পরিস্থিতি দেখে। শুরুতে করোনা মোকাবিলার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতেই ছিল। চীনে প্রথম করোনা চিহ্নিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আড়াই মাস সময়ও পেয়েছিল। কিন্তু এই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন’ এই বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই করেনি। সরকার সমর্থক ডাক্তার নেতা এবং বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী সেদিন এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘শূন্য প্রস্তুতি’ নিয়ে ‘পূর্ণ প্রস্তুতি’র গল্প শোনাচ্ছিল।
আমার ধারণা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আসলে করোনার ভয়াবহতাটা বুঝতেই পারেনি। তাই তারা বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় মনিটরিং নিশ্চিত করেনি। একটা যথাযথ কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানায়নি। করোনা টেস্টের কোনো ব্যবস্থাই প্রায় করেনি। করোনা চিকিৎসার জন্য কোনো হাসপাতাল তৈরি করেনি। অথচ বাংলাদেশ যে সময় পেয়েছিল, তাতে সকল প্রস্তুতি নিয়েই করোনা লড়াই শুরু করতে পারতো। নিজেরা বুঝতে পারেনি, তাই প্রধানমন্ত্রীকেও বিভ্রান্ত করেছে। এই সুযোগে করোনাভাইরাস আরামে বাংলাদেশে ঢুকেছে। আর প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে থাকা নেতারা ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা করোনা মোকাবিলা করেছি, করোনা সাধারণ জ্বর-কাশির মতোই’ এইসব বাগাড়ম্বর করে জাতিকে আরও বিভ্রান্ত করেছেন। শেষ পর্যন্ত চারপাশের সব মাইক অফ করে দিয়ে শেখ হাসিনা নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন যদি শেখ হাসিনা বলেন, আমি একাই সব কাজ করি, এটা নিয়ে যাদের আপত্তি তারা এখন কোথায়? কী জবাব দেব আমরা।
শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেয়ার কারণেই করোনার বিস্তার থেমে গেছে বা মৃত্যু বন্ধ হয়েছে বা শেখ হাসিনা শুরু থেকে দায়িত্ব নিলেই করোনা বাংলাদেশে ঢুকতে পারত না; ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই এমন নয়। চীন, আমেরিকা আর ইউরোপের উন্নত সব দেশে যেখানে মৃত্যুর মিছিল; সেখানে বাংলাদেশ কীইবা করতে পারতো? কিন্তু অনেকসময় কিছু করতে না পারলেও চেষ্টাটা অন্তত করা যায়। সেই চেষ্টায় আন্তরিকতা থাকলে মানুষ সেটা বোঝে, উপলব্ধি করে। আসলে শুরুতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে বেহাল দশা ছিল, তা চললে এতদিনে কী হতো ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে। অনেকে বলেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা। আমি বলি, ব্যবস্থাপনা থাকলেই তো অব্যস্থাপনার প্রশ্ন। দুর্নীতি ছাড়া এতদিন এখানে আর কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না। সবকিছু যেন চলছিল আল্লাহর ওয়াস্তে। নিজেরা তো কিছু করেইনি, এমনকি প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পরও নকল এন-৯৫ সরবরাহ করে ডাক্তারদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে প্রধানমন্ত্রীর চলার পথকে পিচ্ছিল করার দায় এই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য হলো, তিনি কাজের জন্য কাউকে পাশে পান না। বরং পদে পদে তাঁর কাজকে বিতর্কিত করার জন্য লোক খাড়া। দরিদ্র মানুষের জন্য চাল পাঠালেন, তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা সেখানেও চুরি করল। অবস্থাসম্পন্ন আওয়ামী লীগ নেতারাও সপরিবারে নিজেদের নাম তুলে দিলেন ত্রাণের তালিকায়। ঈদকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে মোবাইলে আড়াই হাজার করে টাকা পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। সেই তালিকা নিয়েও নয়ছয়। এটাই যেন নিয়তি।
Advertisement
শেখ হাসিনা যাই করবেন, তার দলের কিছু লোক যেন তাঁকে পেছন থেকে টেনে ধরবেনই। এখন শেখ হাসিনা কি মূল কাজ ফেলে এই চোরদের ধরবেন। মূল কাজ করেই সেটাও করলেন। ত্রাণের চাল চুরির খবর এখন আর আসে না। মোবাইল নম্বর দিয়ে নয়ছয় করা লোকগুলো টাকা তো পায়ইনি, উল্টো এখন দৌড়ের ওপর আছে। সহযোগিতা না করুক, এই চোরগুলো যদি অন্তত এই দুর্যোগের সময়টা ঘরে বসে থাকত; তাতেও শেখ হাসিনার কাজটা অনেক সহজ হতো।
শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাই তাঁকে সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়। তাই তিনি একাই হয়ে ওঠেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী। সব দিকেই তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। কারণ করোনা শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আর সেই প্রভাব শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। তাই শুরুতেই আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তিনি অর্থনীতিকে ঠেকা দেয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি জানেন, অর্থনীতির যাই হোক, আমাদের খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে হলে কৃষির বিকল্প নেই। তাই ঠিকমতো বোরো ধান গোলায় তুলতে এই সাধারণ ছুটির মধ্যেও নিলেন অসাধারণ সব ব্যবস্থা। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করলেন, যাতে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে। ফসলটা ঠিকমতো ফলাতে পারলে, বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের যে পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা থেকে নিজেদের রক্ষা করা যাবে।
আমি খালি দেখি আর অবাক হই, একজন মানুষ কীভাবে এতদিকে খেয়াল রাখেন, এতকিছু ভাবেন। করোনা সমস্যার প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি দিক মাথায় রাখতে হয় তাঁকে। করোনা ছড়ানো ঠেকাতে সাধারণ ছুটি দিলেন। কিন্তু সাধারণ ছুটি দিলে মানুষ খাবে কী? তাই তাদের দুয়ারে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। খাবার পৌঁছানোর পথে যেহেতু দুর্নীতির বাধা, তাই এবার মোবাইলে পাঠিয়ে দিলেন নগদ টাকা। আবার দিনের পর দিন সাধারণ ছুটি থাকলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই আস্তে আস্তে সচল করছেন অর্থনীতির চাকা। তাঁকে আসলে সব দিকই চিন্তা করতে হয়।
করোনার বিরুদ্ধে যে লড়াইটা লড়ছেন শেখ হাসিনা, সেটা তার একার লড়াই। তার আশপাশে কিছু বিশ্বস্ত আমলা ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তিনি নিয়মিতই ভিডিও কনফারেন্সেরে মাধ্যমে সারাদেশের খোঁজ রাখছেন। খালি একটাই অনুরোধ আমলাদের ওপর পুরো বিশ্বাস করবেন না। তারা আগের মতোই আপনাকে বলবে ‘সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন, সব ঠিক আছে। সব ঠিকঠাক চলছে।‘ আপনি বরং তাদের কাছে জানতে চান, কোথায় ঘাটতি আছে, কী করলে সেই ঘাটতি মেটানো যাবে। জেলা প্রশাসকের চেয়ে সিভিল সার্জনের কথা শুনুন। সরাসরি ডাক্তার বা রোগীদের অভিজ্ঞতা শুনুন।
মনে আছে নিশ্চয়ই, নারায়ণগঞ্জের এক ডাক্তার একদিনে অনেক কিছু বদলে দিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের সেই ডাক্তার কিন্তু ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা, আপনার সত্যিকারের শুভাকাঙ্খী। যারা সারাক্ষণ বলে, সব ঠিক আছে, তারাই আসলে ঠিক নেই। বাংলাদেশে সব ঠিক থাকা সম্ভব নয়। বেঠিকগুলো শুনুন, অগ্রাধিকার তালিকা করে বেঠিকগুলো ঠিক করুন। সারাক্ষণ 'চমৎকার, হুজুরের মতে অমত কার' না শুনে সাধারণ মানুষের কথা শুনুন। হাসপাতালে হাসপাতালে মানুষের হয়রানির কথা শুনুন। এতদিন পরও কেন, পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে মানুষকে মরতে হয়। করোনা টেস্ট করতে কেন দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়; সে কথা দরদ দিয়ে শুনুন। আমি জানি, আপনি চাইলেই আপনার মতো করে তৃণমূল পর্যায়ের সত্যিকারের চিত্রটা জানতে পারবেন। গোটা বাংলাদেশ আপনার হাতের তালুর মত চেনা।
আপনার দেয়া প্রণোদনার টাকা যেন যেখানে দরকার সেখানেই যায়, মাঝখানে যেন কোনো দুর্নীতি না হয়, তা নিশ্চিত করুন। আপনার আন্তরিক চেষ্টা যেন দুর্নীতির চোরাবালিতে হারিয়ে না যায়। আমি নিশ্চিত আপনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে পারবে।
শেখ হাসিনা সব দেখছেন বলেই যে বাংলাদেশে আর কোনো করোনা আক্রান্ত হবেন না, আর কেউ মারা যাবেন না, ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন; তারা অন্তত জানবেন; একজন কেউ গভীর মমতা নিয়ে তাদের পাশে আছেন। এই মমতামাখা মুখটাই শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর থেকে গত ৩৯ বছর ধরে যিনি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শেষ ভরসা।
এইচআর/বিএ/জেআইএম