দেশজুড়ে

‘গাড়ি আটকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করতে বলেন এসআই’

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা উত্তরপাড়া গ্রামে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন আনোয়ার হোসেন। তিন পেশায় অটোরিকশাচালক।

Advertisement

তার ভাষ্য, ‘করোনার ক্লান্তিকালের শুরুতে কাজ না থাকায় ঘরে খাবার সঙ্কট ছিল। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলাম। ক্ষুধার তাড়নায় একসময় বাধ্য হয়ে অটোরিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নিই। আঞ্চলিক সড়কে যাত্রী না থাকায় অন্যান্য অটোচালকদের মতো মহাসড়কে যাই। পুলিশের এক সোর্স প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মাওনা থেকে জৈনাবাজার পর্যন্ত অটো চলাচলে ২০০ টাকা দাবি করেন। সোর্স বলেন এই টাকা দিলে পুলিশ ডিস্টার্ব করবে না। তার দাবি অনুযায়ী টাকা না দেয়ায় ২ মে বিকেলে ওই সোর্সের সহায়তায় আমার গাড়ি আটক করে ১০ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করতে বলেন মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশের এসআই শাহজাহান। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে মাসে এক হাজার টাকা সুদ দেয়া শর্তে পাঁচ হাজার টাকা এনে ওই পুলিশ কর্মকর্তার হাতে দিলেও অটোরিকশা ছাড়েননি।’

উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের গোদারচালা গ্রামের অটোচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে আমার অটোরিকশা আটক করে মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশের উপপরিদর্শক শাহজাহান। পরে আমার গাড়ি ছাড়াতে দুই হাজার টাকা নিয়ে দেখা করতে বলেন। ঘণ্টাখানেক পর এক হাজার টাকায় অটোরিকশা ছাড়িয়ে আনি। এ সময় পুলিশের এই কর্মকর্তা তার সোর্সকে ১০০ টাকা ও তালা খুলতে আরও ১০০ টাকা দিতে বলেন। এর আগের দিনও জৈনাবাজারের সড়ক বিভাজন থেকে আমার গাড়ি ওই পুলিশ কর্মকর্তা আটক করলে দুই হাজার ১০০ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, আঞ্চলিক সড়কে যাত্রী না থাকা ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় যাত্রীর চাপ মহাসড়কে। ফলে কিছু সিএনজি ও অটোরিকশাসহ সরকার ঘোষিত অবৈধ যানকে মহাসড়কে চলতে দেখা যায়। হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করেই মহাসড়কে অবৈধ যান চালাচ্ছেন চালকরা।

Advertisement

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার দীর্ঘদিন ধরে মহাসড়কে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রাখায় এখন বিকল্পযানের দাপটে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ব্যস্ত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এসব যানে রাজধানীমুখী হচ্ছেন। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে হাইওয়ে পুলিশও অর্থের মাধ্যমে এসব যানকে নিরাপদে মহাসড়ক ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে। সরেজমিনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জৈনাবাজার থেকে ভবানীপুর এলাকা ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও যাত্রী সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে ২৪ মার্চ থেকে জরুরি কাজে নিয়োজিত যানবাহন ব্যতীত গণপরিবহনসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। প্রথম দিকে মহাসড়কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখন আর আগের মতো অবস্থা নেই।

দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ থাকলেও মহাসড়কের নিষিদ্ধ যান তিন চাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজি, তিন চাকার ব্যাটারিচালিত ভ্যানের দাপটে মহাসড়ক এখন ব্যস্ত। প্রতিদিন এসব যানে সাধারণ মানুষ নিরাপদে ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত গমন করছেন। সড়কে নিয়মিত পুলিশি তল্লাশি চৌকি থাকলেও নানাভাবে প্রলুব্ধ হয়ে এসব যানকে নিরাপদে মহাসড়ক ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছেন।

এছাড়া গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পিকআপ, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারে যাত্রী বহন করা হয়। প্রতিটি তল্লাশি চৌকি পার হতে যান অনুযায়ী পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত পুলিশকে দিতে হয়। অন্যথায় মামলা দেয়াসহ নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়।

Advertisement

বিশেষ করে মাওনা হাইওয়ে থানার অধীন মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় নানা ধরনের বাণিজ্যে নেমেছে হাইওয়ে পুলিশ। প্রতিদিনই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ধশত বাহন আটক করা হলেও পরে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে স্পট বাণিজ্যের অভিযোগও। সারাদিনই হাইওয়ে থানাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পুলিশের সোর্সদের সিন্ডিকেট। তারা গাড়ি আটক ও ছাড়িয়ে নিতে পুলিশের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন।

ময়মনসিংহ থেকে অটোরিকশায় গাজীপুর পর্যন্ত এসেছেন চৌরাস্তা শাখার ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে আমাকে ময়মনসিংহে যেতে হয়েছিল। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাযোগে ফিরে আসি।

‘মহাসড়কে চলতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা হলো মহাসড়কে সব ধরনের যান চলছে। মানুষও চলাফেরা করছেন, শুধু বন্ধ গণপরিবহন। ব্যাটারিচালিত গাড়িতে চারজনের জায়গায় ছয়জন যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এখানেও নেই সামাজিক দূরত্ব। সাধারণ মানুষও তো স্বাস্থ্যবিধি মানছেই না, কয়েকগুণ অতিরিক্ত ভাড়ায় ভোগান্তি নিয়েই চলাচল করতে হয়’ বলে জাগো নিউজকে জানান ব্যাংক কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ।

মহাসড়কের জৈনা বাজারের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক মানিক মিয়া বলেন, বেশি ভাড়া আদায় করলেও আমাদের তেমন লাভ হয় না। মহাসড়কে নিষিদ্ধ থাকায় পুলিশকে ম্যানেজ করতে টাকা দিতে হয়। অন্যথায় গাড়ি আটকে রাখে পুলিশ। পরে আবার টাকা দিয়েই গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে হয়।

মেহেদী ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক রাকিব মিয়ার ভাষ্য, ‘এই সময়টা আমাদের নানা কৌশলে মহাসড়কে গাড়ি চালাতে হয়। একবার ধরলে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা হাইওয়ে পুলিশকে দিতে হয়। অন্যথায় গাড়ি ছাড়ে না। কয়েকদিন আটকে রাখলে গাড়ির ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গাড়ি অচল হয়ে যায়। এজন্য টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়াতে হয়।

এ বিষয়ে মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে তিন চাকার যান নিষিদ্ধ থাকার পরও নানা অজুহাতে মহাসড়কে গাড়ি চালান চালকরা। পুলিশ প্রতিনিয়ত এসব যান আটক করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়। তবে হাইওয়ে পুলিশের টাকা নেয়ার বিষয়টি অবান্তর। মহাসড়কে পুুলিশের তল্লাশি চৌকি পার হতে চলাচলকারী যানের মালিকরা নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়ায় তাদের আটকে রাখা যাচ্ছে না।

গাজীপুর হাইওয়ে জোনের পুলিশ সুপার আলী আহমদ বলেন, মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। চাঁদা নেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

শিহাব খান/এএম/জেআইএম