দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রবর্তিত বহুল প্রশংসিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো : ক) কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং মানবিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা দান। খ) নিরলস জ্ঞানচর্চা ও নিত্যনতুন বহুমুখি মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমপ্রসারণ। গ) জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী থেকে জ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি। ঘ) মেধার বিকাশ এবং সৃজনশীল নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন। ঙ) জ্ঞান, সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নাগরিক সৃষ্টি। জাতীয় শিক্ষানীতিতে উপস্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়ন বলতে গেলে অবশ্যই কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন লাগে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে যেটা সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো সেটা হলো আমি এখানে যোগ দেবার আগে ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রায় ৫/৬ বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এটার কোনো ধরনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় অথবা বলা চলে বাস্তবায়ন সামান্য হওয়ায় অর্থাৎ আড়াই ভাগ শেষ হওয়ায় ওই ৫/৬ বছরের মধ্যে তা বাতিলের তালিকায় চলে যায়। এ কারণে ২০ তলা একাডেমিক ভবনের কাজ শুরু হয়েও ঠিকাদার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে, কারণ কাজ করে সে বিল না পাওয়ার আশঙ্কায় ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ না থাকায় তার চিন্তিত হওয়ার কারণ যৌক্তিক বলা চলে। চলতি বছরে অক্লান্ত চেষ্টায় সেই প্রকল্প পুনর্জীবিত করা হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়েছে; প্রয়োজনে আরো বাড়ানো যাবে, এই মর্মে অনুমতি পাওয়া গেছে সরকারের কাছ থেকে। এটা পাবার পর ঠিকাদার পুনরায় কাজ শুরু করেছে। ১০০ কোটি টাকার একই প্রকল্পের আরেকটি আইটেম ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের কাজ; যেটার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ। এটারও একই অবস্থা হয়েছিল। সেটার মেয়াদ বাড়ানোর পর আবার টেন্ডার করে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। এখন ছাত্রী হলের কাজ চলছে।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের প্রধান কাজ। এর রয়েছে জন্মগত সমস্যা। অন্যান্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পার্থক্য হলো সরকারি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। ফলে জন্ম থেকেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এটি পথ চলা শুরু করে। ২০/২২ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে দেশের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও মাত্র সাড়ে সাত একর জমির উপর এর অবকাঠামো প্রতিষ্ঠিত। জগন্নাথের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে স্থান বা জায়গা সংকট। আবাসনের জন্য জায়গা দরকার। হল করতে হলে যে পরিমাণ জায়গা দরকার তা পাওয়া একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটি ভয়ঙ্কর। ইতোমধ্যে কেরাণীগঞ্জে প্রায় ২১ বিঘা জায়গা কেনা হয়েছে। যেটা সরকারি অনুমোদনে সম্পন্ন হয়েছে। ওই জমিকে কেন্দ্র করে ১২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি ছাত্র হল এবং দ্বিতীয় একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য উক্ত টাকার প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য একনেক বৈঠকে চলতি বছরই পাশ হবে। এক হাজার ছাত্র থাকার হলটি ২০ তলা ভবন হবে। আশা করছি আগামী বছরই এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য তা হলো- কলেজে শুধু পাঠদান করা হয় অর্থাৎ জ্ঞান বিতরণ করা হয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল জ্ঞান বিতরণ নয় জ্ঞান অনুসন্ধান ও আহরণ করতে হয়। জ্ঞান আহরণের বিষয়টা একান্তই গবেষণার ওপর নির্ভরশীল। গবেষণা ছাড়া নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সেই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবেই। গবেষণার কাজটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা একাডেমিক আদলে প্রচলিত। এগুলো করতে হয় এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রামের মাধ্যমে। আমি যোগদান করার পর ইতোমধ্যে এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। অর্থাৎ একাডেমিক গবেষণার দ্বিতীয় বছরে আমরা। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো স্কলারশিপ ছিল না। তা চালু করা হয়েছে বর্তমান প্রশাসনের আমলে। বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার কেন্দ্রস্থলে পরিণত করার জন্য এমফিল ও পিএইচডি কোর্সে ভর্তি প্রক্রিয়া গত বছরের ন্যায় চলতি শিক্ষাবর্ষেও চলছে। অচিরেই ৪০ জন গবেষকের সঙ্গে আরো ৬০জন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। এর বাইরে নতুন করে এখন প্রায় ২০টির মতো গবেষণা প্রকল্প যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীন পরিচালনা করা হবে; সেগুলো নির্বাচন, যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে অর্থ বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। এখন ১৯টি প্রকল্পের গবেষণা কাজ পরিচালিত হচ্ছে। একইসঙ্গে ইউজিসি’র অর্থায়নে এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় যে গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ছিল তার কয়েকটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। উপরন্তু নতুন করে ৩টি গবেষণা প্রকল্প চালু আছে সেগুলো বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত। এছাড়া খুব স্বল্প অর্থায়নে ইউজিসি কিংবা অর্থবছরের বাজেট থেকে অর্থ সংস্থান করে আরো গোটা বিশেক গবেষণা প্রকল্প বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা পরিচালনা করছেন। এগুলো তাদের ব্যক্তিগত প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোর কয়েকটি সমাপ্তির পথে বাকি দুএকটা দেরি হলেও সময় মতো শেষ হবে। চলতি অর্থবছরেও আমরা কিছু অর্থ বরাদ্দ পেয়েছি। নতুন করে প্রকল্প আহ্বান করেছি এবং নতুন করে আরো গবেষণার কাজ শুরু হবে। এর বাইরে আমাদের অনেক শিক্ষক অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার কাজ করছেন। এখানে পর্যাপ্ত মান সম্পন্ন গবেষণাগার বা লাইব্রেরি সুবিধা না থাকলেও শিক্ষকদের গবেষণা থেমে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআরবি, এটমিক এনার্জি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে যেখানে রিসার্চ ল্যাব আছে সেগুলো ব্যবহার করে তারা গবেষণার কাজ চালাচ্ছে। গবেষণার ফলাফল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশও করা হচ্ছে। কেউ কেউ বিদেশি অধ্যাপকদের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণার কাজ করছেন। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স কম হলেও যাত্রা নিঃসন্দেহে ভাল। উপরন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কাজ হলো- বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ‘হেকেপ’ প্রকল্পের আওতায় আমাদের কয়েকটি বিভাগে গবেষণার অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। সেখানে ল্যাবরেটরি সুবিধা যেমন ফার্মেসি, রসায়ন, কম্পিউটার সায়েন্স প্রভৃতি বিভাগে গবেষণা করার মতো ল্যাবরেটরি তৈরি করতে পেরেছে। আরো কয়েকটি বিভাগে গবেষণাগার তৈরি ও সরঞ্জাম জোগাড় করার কাজ চলছে। এসব প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখলে আমরা বলতে পারব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান নয় জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে।পাঠদানের বিষয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাধুবাদ দিতে হয়। ২০১৩-১৪ এবং ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস যখন বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস চলছে তখনও ক্লাশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় এ প্রতিষ্ঠানের ক্লাশ বন্ধ হয়নি। ক্লাশ ও পরীক্ষা বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। যার কারণে দীর্ঘদিনের সেশনজট দূর করা সম্ভব হয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে ২/৩ বছর জট ছিল তা কমে ২/১ বছর হয়েছে। এমনকি বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে জট দূর হয়েছে। শিক্ষকরা বেশি ক্লাশ নিয়েছেন ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য। অন্যদিকে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- আমাদের শিক্ষক স্বল্পতা ছিল। আজ থেকে ২ বছর আগে কোনো কোনো বিভাগে যেমন ফার্মেসি কিংবা মাইক্রোবায়োলজি ৩/৪ জন শিক্ষক দিয়ে চলছিল। আমরা চেষ্টা করেছি প্রত্যেকটি বিভাগে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত যেটা হওয়া উচিত সেটা করতে। তবে আমাদের কাক্সিক্ষত অনুপাত এখনও পূরণ হয়নি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতকে মাথায় রেখে আমাদের আরো শিক্ষক পদ সৃষ্টি এবং নিয়োগ দেওয়া দরকার।আমাদের সমস্যা এখন ভাল ছাত্র কিংবা মেধাবী শিক্ষক সমস্যা নয়। যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক তারা প্রথম কিংবা দ্বিতীয় পছন্দের মধ্যে জগন্নাথকে রাখে। অন্যদিকে শিক্ষকতা করতে চান তারাও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানের অধিকারী। সেক্ষেত্রে আমরা যাদের নিয়োগ দিয়েছি শিক্ষক হিসেবে তাদের মধ্যে রয়েছে এক ঝাঁক তরুণ প্রভাষক অথবা সহকারী অধ্যাপক। এদের সংখ্যা ৩০০/৩৫০জন। এরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। এরা সবাই মেধাবী এবং জীবনের কোনো পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। পরীক্ষার রেজাল্টে একটা অবস্থান ছিল বলেই তারা শিক্ষক হয়েছে। কারণ এখানে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ। মেধা ছাড়া কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর ফলে আমরা একদিকে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি আর যেহেতু এরা মেধাবী শিক্ষক এবং ভালো ছাত্র ছিল এদের অনেকেই (প্রায় ১০০জন) আবার স্কলারশিপ নিয়ে কিংবা বিভিন্ন রকমের আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করে বিদেশে উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছে। এদের অধিকাংশই উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন প্রভৃতি উন্নত দেশে পিএইচডি ডিগ্রি সমাপ্ত করছে কিংবা শেষ করে ফিরে এসেছে। গত ২ বছর আগে যারা গিয়েছে তারা আগামী বছর ফিরে আসবে।আমি মনে করি এই তরুণ শিক্ষক যারা এখন ডিগ্রি করছে তারা যখন ফিরে আসবে তখন একাডেমিক মান বাড়বে তেমনি গবেষণা কাজেও উল্লেখযোগ্য ‘ব্রেক থ্রু’ পাওয়া যাবে। আশা করছি যে নতুন প্রজন্মের যে শিক্ষক তারা যখন উচ্চতর গবেষণা কাজে নিয়োজিত হবে অর্থাৎ অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন আসবে তখন তারা বসে থাকবে না; দেশে ফিরে তারা সেই অর্জিত জ্ঞানকে পাঠদান ও গবেষণা এই উভয় কাজে ব্যবহার করবে। একটা পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ যেখানে গবেষণা হয়, যেখানে জ্ঞান আহরণ হয় এবং নিয়মিত পাঠদান হয়- সেশনজটমুক্ত- এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারব সেটা প্রত্যাশা করি।বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটা সমস্যা ছিল লাইব্রেরির সমস্যা; তা সমাধান করা হয়েছে। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিছু পুরাতন বই আছে। পুরানো বইয়ের একটা আর্কাইভাল ভ্যালু আছে। অর্থাৎ গ্রন্থাগারে কিছু বই থাকলেও প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব রয়েছে। দৈনন্দিন জ্ঞান বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বই নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে আরেকটা নতুন প্রবণতা হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতে গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়তে পছন্দ করেন না অনেকেই। এখন অনেকেই লাইব্রেরিতে আর যান না। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ব্যবহার করে ই-বুক সিস্টেমে বই পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন। এজন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ই-বুক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ২৬টি বিশ্বখ্যাত প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জগন্নাথ; বিশ্বমান সম্পন্ন টেক্সট-বুক যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষকরা সহজেই পড়তে পারেন সেজন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। ডিসেম্বর নাগাদ ই-বুক সিস্টেম-এ চলে যাবে পুরো গ্রন্থাগার। সকলে বই বা গবেষণা পত্রিকা পড়ার জন্য খুব সহজেই একসেস পাবেন। তবে গত বছর লাইব্রেরির জন্য ৫০ লাখ টাকার বই কেনা হয়েছে। লাইব্রেরিটি ই-লাইব্রেরিতে পরিণত হলে যুগের চাহিদাও পূর্ণ হবে। তবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির অনেকাংশ ই-লাইব্রেরি করা হয়েছে। বড় একটি কক্ষে অনেকগুলো কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থায় পাঠক সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যেহেতু আবাসনের ব্যবস্থা নেই বলেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বেশি সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারে না সেক্ষেত্রে বাসাতেও তারা যাতে ইন্টারনেট ল্যাপটপ ব্যবহার করতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যক্তি প্রতি ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলেই সেই ঋণ পেয়েছে। কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থাকলেই এখানকার প্রত্যেকে একটি ল্যাপটপের মালিক হয়েছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক সদস্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্ঞানের রাজ্যে অবাধ প্রবেশের সুযোগ লাভ করেছে।বর্তমান শিক্ষাবর্ষ (২০১৫-১৬) থেকে দুটি নতুন বিভাগ চালু করেছি। ‘ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন’ এবং ‘শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট’। দেশে বিশের অধিক টিভি চ্যানেল আছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। সেই জাতীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করার যোগ্য লোক তৈরিতে ‘ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন’ বিভাগ কাজ করবে। এ বিভাগে ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছর ৩০ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া অনেকেই ইতোপূর্বে শিল্পী ও কলাকুশলি হয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাতে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না। আধুনিক বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য একাডেমিক প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে। এ খাতে জনশক্তি তৈরিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে বর্তমান সরকার যে শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছে তাতে শিক্ষক প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, নানামুখী শিক্ষা সমস্যার সমাধান অন্বেষণ, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির জন্যই আমরা ‘আইইআর’ প্রতিষ্ঠা করেছি। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষা বিষয়ক একাডেমিক ধ্যান-ধারণা কম। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কাজটা সারাদেশে সম্প্রসারিত হয় সেজন্য এবছর থেকে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আমরা এই ইনস্টিটিউট খুলেছি। এবারই প্রথম ছাত্র ভর্তি করানো হবে। শিক্ষক ও পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সিলেবাসও তৈরি করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের ‘ব্রেক থ্রু’। সরকারের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা মেটানোতে বিরাট ভূমিকা রাখবে এই প্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষা ইনস্টিটিউটের জন্য একটি ল্যাবরেটরি স্কুল দরকার ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পগোজ স্কুলকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ শিক্ষা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের শিক্ষণ পদ্ধতি প্রদর্শনের জন্যই এই স্কুলের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমরা নিজস্ব স্কুল করতে পারতাম। কিন্তু স্থানের অভাবে সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া পগোজ স্কুল ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। তাদের স্থাপনা, স্টাফ, পরিচালনা পরিষদ অক্ষুণ্ণ রেখে জগন্নাথের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতাকে মাথায় রেখে আমাদের সিন্ডিকেট স্কুলটিকে শিক্ষা গবেষণার জন্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বর্তমানে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পাদনের কাজ চলছে। এভাবে একাডেমিক প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।জগন্নাথের সেন্টার ফর ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ পরিণত হয়েছে ‘আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে’। এটি একটি বড় কাজ। পূর্বে এখানে কেবল ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রদান করা হতো। ইউজিসির কাছ থেকে ‘আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে’র অনুমোদন পাওয়ায় আন্তর্জাতিক ভাষা চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হবে এটি। ইংরেজির পাশাপাশি, আরবি, চীনা, ফরাসি, স্প্যানিশ, কোরিয়ান ভাষা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বিশ্ব বাজারে চাকরির সুবিধার ক্ষেত্রে ভাষাজ্ঞান একটি জরুরি প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনের দিকে, বিশেষত কর্মসংস্থানকে মনে রেখেই বিভিন্ন ভাষা প্রশিক্ষণ প্রদান করা এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সমস্যা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে; বাস্তবসম্মত কারণে রাতারাতি সবকিছুর সমাধান সম্ভব নয়। কেউ-ই এ সমস্যা সমাধান করতে পারবেন না। তবে অবকাঠামো উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অবশ্য কয়েক বছরে অবকাঠামো উন্নয়ন করে দেখিয়ে দেওয়ার মনোভাবের চেয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন করে একাডেমিক উৎকর্ষ বাড়ানো জরুরি। আমাদের শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট, কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে তারা কী ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছে, যোগ্যতায় ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে কিনা- এসবই পর্যালোচনা করা দরকার। অবকাঠামো উন্নয়নের নামে দালান-কোঠা বানিয়ে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার স্বপ্ন না দেখে বরং দেশময় কিংবা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে লেখাপড়ার উচ্চ মান; শিক্ষকদের গবেষণা ও প্রকাশনার অভিনবত্ব। গবেষণা ও প্রকাশনা দিয়ে অন্যদের বোঝাতে হবে আমাদের সমুন্নতি। আমি মনে করি উচ্চ মানসম্মত লেখাপড়া, পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়মিতকরণ এবং শিক্ষকদের জ্ঞান অন্বেষী মনোভাব- আপাতত এটুকু হলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হবে।লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/পিআর
Advertisement